ছোটবেলায় রাতে ভূতের গল্পের বই পড়া হতো বিশেষ আয়োজন করে। ঘরে স্বল্প ওয়াটের বাতি জ্বালানো হতো। এই বাতি জ্বালানোর উদ্দেশ্য, একটি আমেজ তৈরি করা। আলগোছে জানালার পর্দাটা সরানো হতো, যাতে বাইরের অন্ধকারটা চোখে পড়ে। বই নিয়ে বসতাম জানালার সামনে। অনেকটা ভূতদের লোভ দেখিয়ে ডেকে আনার মতো ব্যাপার।
গল্প পড়া শুরু হতো। গল্পে গুঁড়া সাইজের একটি রাজকন্যা আছে। একে ঘিরেই কাহিনি। এই গুঁড়া রাজকন্যা সারা দিন খালি শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। এত বই পড়ে হবে কী?
গল্পে একটু পরপরই ভয়ংকর ভূত-পেতনি এসে হাজির হচ্ছে। রাজকন্যাকে এরা তুলে নিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছে। লেখক এত ভূত-পেতনি কোথায় পেতেন কে জানে! সাত বছরের রাজকন্যার রূপের বর্ণনা পড়ে জানতে ইচ্ছে করত এই পিচ্চি কোন ক্লাসে পড়ে। একদিন দেখা করে ছোট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিতে হবে। তাতে লেখা থাকবে: ভূতটা আবার যেদিন আসবে, সেদিন দুজনে মিলে সেটাকে ধরে একটা ছোট শিশিতে ভরে ফেলব। রাজি? রাজি থাকলে বুড়ো আঙুল মিলাও, আর রাজি না থাকলে কাট্টি নাও ছোট আঙুল দিয়ে। খবরদার, বিষয়টা যেন আর কেউ না জানে।
জানালার কার্নিশে হঠাৎ হঠাৎ কিসের যেন আলো এসে পড়ত। চমকে উঠতাম। এই আলো কিসের? ভূত কি সত্যিই এসে গেল? হঠাৎ চলে যেত বিদ্যুৎ। ‘বাবা গো’ বলে বিকট এক চিৎকার দিতে গিয়েও কোনোমতে সামলে নিতাম। সবাই বলেছে, আমি বড় হচ্ছি। এই তো আমি ফাইভে উঠেছি, একা একা স্কুলে যাই। এই অবস্থায় ভূতের ভয়ে চিৎকার দিয়ে বসলে আবার ছোট হয়ে যাব। এত বড় বোকামি করার কোনো মানে হয় না।
কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ চলে আসত। আমি আর বই নিয়ে বসার সাহস পেতাম না। বারবার মনে হতো, ভূতটা খাটের নিচে আছে। খুটুরমুটুর শব্দও শোনা যাচ্ছে। চুপচাপ কাঁথার নিচে ঢুকে শুয়ে থাকতাম, যদিও বারবার মনে হতো গুঁড়া রাজকন্যাটা বইয়ের ভেতরে বসে আছে একলা। আমার সেখানে যাওয়া বিশেষ দায়িত্ব। তবে এই দায়িত্ব পালন আপাতত সম্ভব নয়। পরদিন সকালে উঠেই খাটের নিচে আলো ফেলে দেখতাম ভূতটা গেছে কি না। হ্যাঁ, চলে গেছে।
অনেক কষ্টে জমানো মাটির ব্যাংকে মোট ৫৭ টাকা জমেছিল। ব্যাংক ভাঙার পর টাকাগুলো দেখে কী যে আনন্দ! এত টাকা দিয়ে কী করা যায়? ভূতের বই কেনা যায় অনেকগুলো। অবশ্য ক্যাসিও কোম্পানির একটা ছোট ঘড়িও কেনা যায়। যে বাচ্চাগুলো ঘড়ি পরে বাবার হাত ধরে স্কুলে আসে, তাদের দেখতে বেশি সুন্দর লাগে। আমার অবশ্য বাবা নেই। কোনটা কিনি? ভাবতে ভাবতে বিশটি বছর চলে গেল।
কতগুলো বছর ধরে ভূতের গল্পগুলো শেলফে ঘুমিয়ে আছে। আর ভূতটা? হয়তো সে বেঁচে নেই। কিংবা হয়তো সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোনো দিন ভয় দেখাবে না। একটি যান্ত্রিক নগরী ছেড়ে সে হয়তো ফিরে গেছে, ঠিক যেমন মানুষগুলো একদিন ফিরে যায় আপন অন্ধকারে।
বিশেষ বিশেষ সময় আমার খুব ইচ্ছে করে সেই ছোট্ট রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলতে। তাঁর বয়স এখন কত? বইয়ের রাজকন্যার বয়স কি বাড়ে? আমাকে দেখলে কি সে চিনতে পারবে? আমি উঠে গিয়ে শেলফ থেকে বইগুলো হাতে নিই। হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। কত বছরের পুরোনো এক গল্প! দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দা উড়তে থাকে। কার্নিশে হঠাৎ একটা আলো এসে পড়ে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কি দ্বিতীয়বার ফিরে আসছে? একসময় বিদ্যুৎ চলে যায়। আমি চমকে উঠি না, নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি। এই অপেক্ষা কারও জন্য নয়।
জন রাসেল
ঢাকা