রিয়াদে পিটিয়ে-গরম পানিতে ঝলসে হত্যা করা হয় আবিরনকে

খুলনার আবিরন বেগম সরকারি প্রক্রিয়ায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবের রিয়াদে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। দুই বছর তিন মাস পরে গত বছর আবিরন লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। লাশের সঙ্গে থাকা আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা ছিল ‘মার্ডার’ বা হত্যা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, আবিরনের বিদেশ যাওয়া এবং ফেরত আসা পর্যন্ত প্রতি ক্ষেত্রেই অসতর্ক, অপেশাদার এবং অদক্ষ দাপ্তরিক আচার–আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থাতেই আবিরনের বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আবিরনকে হাত বদল করে বিদেশ পাঠানো বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি, দালালসহ তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছরের ২৪ অক্টোবর কফিনে মুড়ে আবিরনের লাশ দেশে ফেরে। এই ঘটনা তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক সদস্যবিশিষ্ট একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে। কমিশনের অবৈতনিক সদস্য ড. নমিতা হালদার তথ্যানুসন্ধান করে কমিশনের কাছে গত ১৫ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দেন। গত ১০ মে অনলাইনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের সভার এজেন্ডায় আবিরনের ঘটনাটি আলোচিত হয়। কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। পরে কমিশনের চেয়ারম্যান সরাসরি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলবেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা কাজ করছেন, তাঁদের সুরক্ষায় কমিশনের পক্ষ থেকে ওই সব দেশের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রায় ২০ বছর আগে সন্তান না হওয়ায় স্বামী তাড়িয়ে দিলে আবিরন বাবার বাড়ি ফেরত এসেছিলেন। বিদেশ গিয়েছিলেন বোনদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ জোগাতে।

বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন আবিরন। অথচ ফিরেছেন লাশ হয়ে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নমিতা হালদার। বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে অর্থাৎ বিভিন্ন নির্যাতন করে খুন করা হয়। সাত মাস সেখানকার এক মর্গে ছিল আবিরনের লাশ। আবিরন যে বাসায় কাজ করতেন, ওই মালিক ও মালিকের স্ত্রী সেখানকার কারাগারে আছেন। অন্যদিকে সরকারি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দিয়ে দিয়ে মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মাধ্যমে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সিসহ বিভিন্ন জনের সহায়তায় আবিরনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই। একটি চক্র অনৈতিকভাবে প্রতারণা করে আবিরনদের মতো অসহায়, দরিদ্র নারীদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি।’ গত বছরের ২৫ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগর গ্রামে আবিরনের বাবা আনছার সরদারের (৭০) বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শনে যান নমিতা হালদার।

আবিরন দুই বছরের বেশি সময় কাজ করলেও তাঁর পরিবার বেতনের টাকা পায়নি। দালালচক্রসহ অন্যরা এ টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে পরিবারের অভিযোগ। মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন এবং আবিরনের বোন রেশমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবিরন যে বাসায় কাজ করতেন, সেখানে মোট আটজন পুরুষ থাকতেন। তাঁরা আবিরনকে যৌন নির্যাতনও করতেন। এর বাইরে খাবার খেতে না দেওয়া, গ্রিলে মাথা ঠুকে দেওয়াসহ নানান নির্যাতন তো ছিলই।

নমিতা হালদার জানান, কমিমনের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আবিরনের মামলাটি যখন আদালতে যাবে, তখন তা পরিচালনায় কমিশন থেকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হবে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর দালাল রবিউলকে প্রধান আসামি করে ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলাটি করা হয়। নমিতা হালদার বলেন, ‘আবিরনের পরিবারের পাশে কমিশন থাকার পরও দেশে মামলা করা থেকে শুরু করে প্রতি পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মামলাটি বর্তমানে খুলনার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’

বোন আবিরনের লাশ নিতে বিমানবন্দরে আসেন ছোট বোন রেশমা খাতুন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রিয়াদে বাংলাদেশ দুতাবাস আবিরনের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। আবিরনের পরিবার থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি চাওয়া হয়েছে। আবিরনের বোন রেশমা খাতুনের স্বামী এস এম আইয়ুব আলী জানালেন, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ ফরমেট তৈরিতে বাংলাদেশের যে আইনজীবী সহায়তা করেছেন, তিনি ভুলভাবে তা উপস্থাপন করেছেন। ফলে প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে গেছে। অন্যদিকে খুলনার পাইকগাছা থানার এ মামলার প্রধান আসামি দালাল রবিউল মোড়লকে গ্রেপ্তারের আগেই একটি উকিল নোটিশ দেখিয়ে থানা থেকে প্রচার করা হয়, রবিউল হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। পরে অবশ্য রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী নিপুল চন্দ্র গাইনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পর হাইকোর্টে রিট করায় এ কর্মচারির বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এস এম আইয়ুব আলী বলেন, গত বছরের ২৪ অক্টোবরের আগেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, আবিরনের লাশ দেশে এসেছে। তবে ওই লাশ ছিল অন্য নারীর। শুধু নামটাই মিল ছিল আবিরনের সঙ্গে। তারপর যখন সত্যি সত্যি আবিরনের লাশ আসে, তা এতটাই বীভৎস ছিল যে তা দেখার মতো ছিল না। আবিরনের পরিবার লাশ পরিবহন, সৎকারসহ সরকারের কাছ থেকে মোট ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছে। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন করাসহ বিভিন্নভাবে আবিরনের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।

নমিতা হালদার তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে রিয়াদ দূতাবাসের মাধ্যমে আবিরনের জন্য ক্ষতিপুরণ আদায়, অভিযুক্ত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে এয়ারওয়ে ইন্টারন্যাশনালসহ অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজিন্সিগুলোর বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, আবিরনের জীবনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলেছেন। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বাের্ডের অফিস সহকারী নিপুল চন্দ্র গাইন এবং দালাল রবিউলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ, বিএমইটির এমিগ্রেশনে আবিরনকে দুবার রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য দায়ী কর্মচারীদের চিহ্নিতপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। সাধারণ সুপারিশে নারী কর্মীদের বিদেশ পাঠানোর আগে ভাষাশিক্ষাসহ পুরো কার্যক্রমকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনার সুপারিশসহ নারী কর্মীর নিরাপত্তায় বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন।

বোন আবিরনের লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন রেশমা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

নমিতা হালদার বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রথমবার আবিরন কেন বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরে যান, তা কোনোভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও প্রশ্নের সদুত্তর বা সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ দিতে পারেননি। পুরো চক্রকে আইনের আওতায় আনা হলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) বরাবর লেখা গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের এক চিঠিতে উল্লেখ করা ছিল, বছরটির ২৪ মার্চ আবিরন মারা যান। তবে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’–এ আবিরনের মৃত্যুর তারিখ লেখা আছে বছরটির ১৭ জুলাই। অর্থাৎ প্রতিপদে পদেই আবিরনের ঘটনা অনিয়ম ও অবহেলার শিকার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নমিতা হালদার। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে আবিরনের লাশ দেশে আনা হয়।

আরও পড়ুন: 
কফিনে ফিরল আবিরনের স্বপ্নও