স্কুলে গণিত, বিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞানের ক্লাস ভালো লাগত না। ক্লাসে মন না দিয়ে তাই খাতার পেছনে আঁকিবুঁকি করতেন পুনম সাহা। কে জানত, ক্লাসের পড়া নয়, খাতার পেছনের সেই আঁকিবুঁকিই তাঁর ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করবে!
আমরা যাকে ‘আঁকিবুঁকি’ বলছি, তার কেতাবি নাম ডুডল। পুনম সাহা একজন পেশাদার ডুডল আঁকিয়ে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ডুডল আঁকেন তিনি। ঢাকার নামী রেস্তোরাঁর দেয়াল থেকে শুরু করে ভিনদেশি ব্র্যান্ডের টি-শার্ট—নানা জায়গায় স্থান পেয়েছে তাঁর ডুডল। ডুডল আঁকার সুবাদেই শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ‘ইনোভেশন ফর চেঞ্জ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন পুনম। তাঁর আঁকা মনডালা (এক ধরনের জ্যামিতিক নকশা) নিয়ে খবর ছেপেছে জাপানি পত্রিকা।
শখ থেকে পেশা
পুনম তখন ‘ও লেভেল’ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পেলেন কিছু লোগো আঁকার প্রস্তাব। ‘তখনো আমি ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিইনি। সেই ভাইয়ারা ফ্রিল্যান্সার, আপওয়ার্ক, এ রকম বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ডিজাইনের কাজ পেতেন। কিছু কাজ আমাকে দিয়েছিলেন। দেখা যেত মাস শেষে ৫, ১০, কখনো ১৫ হাজার টাকাও পেতাম। ভাবছিলাম ছবি আঁকা তো আমার শখ। শখ থেকে যদি কিছু আয় হয়, ক্ষতি কী?’ বলছিলেন পুনম।
এ লেভেল পেরোনোর আগপর্যন্ত এভাবেই চলছিল। একটা স্কুলে খণ্ডকালীন চাকরি আর টুকটাক আঁকাআঁকি করে আয় হচ্ছিল ভালোই। তখন পর্যন্ত পুনমের লক্ষ্য ছিল স্রেফ অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করা।
২০১৫ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর আঁকাআঁকির পরিধিটা আরও বড় হলো। বন্ধুবান্ধবদের উৎসাহে ডুডলবাগ নামে একটা ফেসবুক পেজ খুলে ফেললেন। সেখানে তুলে দিতে শুরু করলেন তাঁর আঁকা ডুডল। এরপর ক্যাম্পাসের সিনিয়রদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ হাতে আসতে শুরু করল।
তবে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পুনমের আঁকা পৌঁছে গেল একটা নোটবুকের প্রচ্ছদ করার পর। ‘নর্থ সাউথের কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা স্টার্টআপ চালু করেছিল। ওদের জন্যই গেম অব থ্রোনস থিমের ওপর একটা নোটবুকের প্রচ্ছদ করলাম। সিরিজটার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। সে জন্যই বোধ হয় অনেকে কাজটা পছন্দ করেছিল। দেখা গেল ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে সেই নোটবুক,’ বলেন পুনম।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাবা মারা যাওয়ার পর একটা বড় ধাক্কা খেলেন পুনম সাহা। পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেমন, তাতে নর্থ সাউথের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে উঠল। তার ওপর বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবেও কাঁধে চেপেছিল অনেক দায়িত্ব। সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে পরের কয়েকটা বছর। বেসরকারি আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি টিউশনি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে লোগো ডিজাইন, অন্দরসজ্জা বা ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ—সব করেছেন পুনম।
আর ১০ জন অভিভাবকের মতো পুনমের মা-ও ভেবেছিলেন, এসব আঁকিবুঁকি করে আর কত দিন? মেয়ে কবে নয়টা-পাঁচটা একটা চাকরি নিয়ে থিতু হবে? কিন্তু যখন শ্রীলঙ্কার ‘ইনোভেশন ফর চেঞ্জ’ সম্মেলন থেকে ডাক এল, প্রথমবারের মতো মা বুঝলেন, শখের আঁকিবুঁকি দিয়েই মেয়ে পৌঁছে গেছে অনেক দূর।
টি–শার্ট, মগ, জুতোর নকশা থেকে শুরু করে ট্যাটু
বাংলাদেশে পুনম সাহা বাটা, হুয়াওয়ে, ইউনাইটেড গ্রুপের মতো বড় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাক্কা ঢাকা বা টেকআউটের মতো রেস্তোরাঁর সঙ্গেও কাজ করেছেন। কোনোটা ছোটখাটো প্রকল্প, কোনোটা আবার মাসব্যাপী চুক্তিভিত্তিক কাজ। ক্লুডিও নামের একটা ক্লাউড কিচেন কোম্পানির বিপণন ও ডিজাইন বিভাগে চাকরি করেছেন প্রায় দেড় বছর। তবে পাশাপাশি ডুডলবাগের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টাম্বলারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলো থেকে শুরু করে ওয়েবসাইট—সবই সক্রিয় ছিল পুরোটা সময়। যেখানে তিনি এঁকেছেন নিজের জন্য। আর সেই সুবাদে হাতে এসেছে নানা ধরনের কাজ। নানা দেশে পৌঁছে গেছে তাঁর আঁকা ডুডল।
কখনো হয়তো নেদারল্যান্ডস বা যুক্তরাজ্য থেকে মেসেজ পাঠিয়ে কেউ জানিয়েছে, ‘দেখো, তোমার আঁকা একটা ডুডল দিয়ে আমি ট্যাটু করেছি!’ কখনো নরওয়ের বিজ্ঞাপনী সংস্থা বার্তা পাঠিয়ে বলেছে, ‘তুমি কি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাও?’ পুনম বলছিলেন, ‘নরওয়ের এজেন্সিটা আমাকে নক করেছে রাত একটার সময়। তখন আমি বসে মুভি দেখছি। সেই রাতেই আমি কোম্পানির বসের কাছে ইন্টারভিউ দিয়েছি। তিনি বলেছেন, আমার কাজ, আমার ডেডিকেশন তাঁর ভালো লেগেছে। সরাসরি চাকরির প্রস্তাবই দিলেন তিনি। ঘরে বসেই আমি করতে পারব। স্যালারিও বেশ ভালো। তাই আমিও প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিলাম।’ এখনো সেই নরওয়ের প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করছেন পুনম।
প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এই যে এত এত জায়গা থেকে হুটহাট কাজের প্রস্তাব আসে, আপনার কখনো মনে হয়নি—এটা স্প্যাম না তো? কেউ ফাঁদে ফেলছে না তো?’ তরুণ এই আঁকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, যখন চীনা অনলাইন মার্কেটপ্লেস শিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল, সেটা আমি সত্যিই স্প্যাম ভেবেছিলাম। ওরা আমাকে কিছু ডিজাইন পাঠাতে বলেছিল ওদের টি–শার্ট, মগসহ বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহার করার জন্য। দেখলাম কাজ জমা দেওয়ার আগেই পারিশ্রমিক পাঠিয়ে দিয়েছে। খুব অবাক হয়েছিলাম। ওদের প্রোডাকশন সিস্টেমে অনেক ধাপ পার হতে হয়। তাই আমি কাজ জমা দেওয়ারও প্রায় ছয় মাস পর আমার নকশা করা টি–শার্ট ওরা বাজারে এনেছে। ওরা আমাকে জানিয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে সবগুলো টি–শার্ট বিক্রি হয়ে গেছে। প্রায় ১১০টি দেশ থেকে মানুষ টি–শার্টগুলো কিনেছে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তিটা টের পাওয়া যায় পুনমের গল্প থেকে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কাজ পেয়েছেন, প্রশংসা পেয়েছেন। একবার তাঁর আঁকা ডুডল ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন মার্কিন অভিনেতা জোসেফ গর্ডন লেভিটও! হঠাৎ এক দিন ঘুম থেকে উঠে বিষয়টি আবিষ্কার করে তাজ্জব বনে গেছেন পুনম সাহা।
জানতে চেয়েছিলাম, ‘এই যে ধাপে ধাপে এগোলেন...আপনার কাছে টার্নিং পয়েন্ট কোনটা? গেম অব থ্রোনসের সেই নোটবুক, শ্রীলঙ্কার সম্মেলন, নাকি শিনের কাজ?’ পুনম বললেন, ‘আমার মনে হয় কোনোটাই নয়। আমার জীবনে কোনো পরিবর্তনই রাতারাতি আসেনি। আমি ধাপে ধাপে একটু একটু করে এগিয়েছি।’
ছেলেবেলার শখটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পেছনে পুনমের সবচেয়ে কাজে এসেছে সম্ভবত লেগে থাকার গুণ। জীবনে ঝড়ঝাপটা এসেছে। কখনো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন, কখনো টিউশনি ছেড়েছেন। কিন্তু আঁকাআঁকি তিনি কখনো ছাড়েননি।