গত ৯ জুলাই বাংলাদেশে এসেছিলেন নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা জরিগুয়েতা সেরুতি। ১০ জুলাই রানি দ্বিতীয়বারের মতো গিয়েছিলেন গাজীপুরের ঝর্না ইসলামের কাছে। হস্তশিল্পের কারিগর থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ঝর্না ইসলামের কথাই রইল এখানে।
রানির সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তটা ঝর্না ইসলামের কাছে এক মাস পরও যেন সজীব। তাই আলাপের শুরুতে সে কথাই বলছিলেন, ‘২০১৫ সালে রানি প্রথম এসেছিলেন। সে সময় রানির সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে পারিনি। এবার কিন্তু তেমনটা হয়নি, অনেক কথা হয়েছে।’
তো, রানির সঙ্গে এবার কী কথা হলো? প্রশ্ন শুনে হাসিমুখে ঝর্না ইসলাম বলে যান সেই কথা, ‘তিনি আমার কাজের খোঁজ নিলেন। সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে রুমাল, ঝুড়ি, নৌকা ও কিছু শোপিস বানিয়ে উপহার দিয়েছি। উপহার পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন।’
গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকায় ঝর্না ইসলামের বাড়ি। এখানেই তাঁর গড়া ছোট কারখানা। ১০ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো ঝর্নার এই কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা। সেদিন রানি ২০ মিনিটের বেশি সময় ঝর্নার কারখানায় কাটান। রানি তাঁর কারখানার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন।
স্বাভাবিকভাবেই মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়, রানি কেন গেলেন ঝর্নার কাছে?
সেই গল্প জানতে হলে জানতে হবে ঝর্না ইসলামের দুঃসময়ের কথা, তাঁর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জীবনের কথা।
জীবনের সেই গল্প বলতে গিয়ে অনেকটা দুঃখমাখা গলায় ঝর্না ইসলাম বললেন, ‘ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর থেকেই আমার কষ্টের শুরু। ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়। ইচ্ছা থাকলেও পড়াশোনা করতে পারিনি। একসময় ভেবেছিলাম, স্বামীর সংসারে হয়তো ভালোই থাকব। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর আবার সেই কষ্টের পুনরাবৃত্তি।’
বিয়ের পর ঝর্না ইসলামের সংসার ভালোই চলছিল। মাস শেষে বিদেশ থেকে স্বামী শামসুল ইসলাম টাকা পাঠান। সেই টাকায় দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটত। কিন্তু ১৯৯৩ সালের কোনো একদিন শামসুল ইসলাম দেশে ফিরে আসেন। পুঁজি হিসেবে যে টাকা নিয়ে আসেন, তাও হারান প্রতারণার শিকার হয়ে। পরিবারে শুরু হয় আর্থিক অনটন। দুই সন্তানকে নিয়ে বেকায়দায় পড়েন ঝর্না ইসলাম।
ঝর্না ইসলাম হস্তশিল্পের কাজ জানতেন। সংসারের হাল ধরতে শুরু করেন কাপড়ে নানা নকশার কাজ। হাতে সেলাই করে পরিচিতদের কাছে বিক্রি করে দেন। কয়েক বছর ধরে এই কাজই করেন। এ থেকে দৈনিক যা আয় হতো তাতে সচ্ছলতা আসেনি। বাধ্য হয়ে ১৯৯৮ সালে ব্র্যাক থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই টাকায় একটি সেলাই মেশিন কেনেন। তাতেই শুরু করেন কাপড় তৈরির কাজ।
ছোট টিনশেড দোকানে দরজির কাজে অল্প দিনেই সাড়া পান। মেয়েদের কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের নকশার কাজ করে দিতেন। সুন্দর নকশার কারণে দোকানে ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ করে আবারও বাড়তি ঋণ নেন। বাড়ে সেলাই মেশিনের সংখ্যা। এরপর বাহারি নকশায় তৈরি করতে শুরু করেন সালোয়ার, ওড়না, টপসসহ নারীদের বিভিন্ন পোশাক।
রানি জানলেন ঝর্নার কথা
২০১৫ সালের জুলাই কি আগস্ট মাসের কথা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া ৩৫ জন নারীকে ডাকা হলো গাজীপুরের সাতাইশ এলাকার একটি পোশাক কারখানায়। সেখানে অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত গার্বেন ডি জং। তিনি উপস্থিত ঋণগ্রহীতাদের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কেউ জানালেন হাঁস-মুরগি পালনের কথা, কেউবা কৃষিকাজের কথা, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসার কথা জানালেন। এর মধ্যে ভিন্ন এক গল্প শোনালেন ঝর্না ইসলাম। সেদিনের কথাই বলছিলেন ঝর্না ইসলাম, ‘বলেছিলাম এই ঋণের টাকায় ধীরে ধীরে ছোট পরিসরে আমি একটি তৈরি পোশাক কারখানা দিয়েছি, সেখানে কাজ করেন কয়েকজন শ্রমিক। ডাচ্ রাষ্ট্রদূত সেই কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হলেন।’
তিনি ঝর্নার কাছে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলেন। ঝর্নাও আগ্রহ নিয়ে নিজের সাফল্যের কথা বললেন। বললেন, ঋণের টাকায় তিনি প্রথমে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। নিজের করা নকশায় তৈরি করেন মেয়েদের বিভিন্ন পোশাক। সেগুলো বিক্রি করে সচ্ছলতা ফেরে তাঁর। কাজের চাহিদা বাড়ে, কয়েকজন কর্মী নিয়োগ দেন। তৈরি করেন একটি ছোট্ট কারখানা।
ঝর্নার কথাগুলো রাষ্ট্রদূত গার্বেন ডি জং শুনে মুগ্ধ হন। ওই দিন বিকেলেই ঝর্নার কারখানা দেখতে যান তিনি। এ সময় কারখানা পরিদর্শন শেষে ঝর্নার তৈরি বিভিন্ন পোশাকের ছবি তোলেন। সে সময় নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমার বাংলাদেশ সফরের কথা। রাষ্ট্রদূত ঝর্নার গল্প প্রতিবেদন আকারে রানির কাছে পাঠান।
রানি এলেন ঝর্নার কাছে
২০১৫ সালেই রানি এলেন বাংলাদেশে। রাষ্ট্রদূতের পাঠানো ঝর্না ইসলামের সাফল্যের দৃষ্টান্ত দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা রানির কার্যতালিকায় ছিল। তিনি ছুটে গেলেন ঝর্নার কাছে। এদিকে ঝর্না ইসলামের কাছে বিষয়টি স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। স্বয়ং রানি তাঁর কাছে আসবেন, এ যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ঝর্না ইসলাম বলছিলেন, ‘এত বড় মাপের মানুষ আমার বাড়ি আসবেন, এটা আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন। আমি কী এমন করলাম যে কারণে রানি আমার বাড়ি আসবেন, সেটাও ঠাওর করতে পারছিলাম না।’
রানি এলেন। এ সময় ছয়টি সেলাই মেশিন উপহার দেন ঝর্না ইসলামকে। তা দিয়ে আরও বড় হয় ঝর্নার কারখানা। তাঁর তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ে। তাঁর শুরুর সেই দোকানের পাশে রয়েছে পোশাক তৈরির ছোট কারখানাটি। সেখানে রয়েছে আটটি মেশিন। কাজ করছেন ১৬ জন নারী।
ঝর্না ইসলাম বলছিলেন, ‘আমি কারও করুণায় বাঁচতে চাইনি। সব সময়ই ইচ্ছা ছিল আমি নিজে কিছু করব। এই চাওয়া থেকেই এটুকু পথ এসেছি।’
হস্তশিল্পের কাজ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হতে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে তাঁকে। কখনো আর্থিক, কখনো মানসিক, কখনোবা সামাজিকভাবেও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। সংসারেও সচ্ছলতা ফিরেছে। বড় কথা, তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় অনেক নারী পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তিনি যেমনটি বলছিলেন, ‘আমাকে দেখে এখন অনেকেই এ কাজ শুরু করছে। তারা আমাকে দেখে শিখছে—এ কথা শুনে খুব ভালো লাগে। তা ছাড়া আমার ছোট কারখানাতেও অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। অনেকের পরিবার চলে এই কারখানার ওপর। এর চেয়ে ভালো লাগার আর কী থাকতে পারে।’
আর রানির এবারের আগমন?
‘আমার মতো একজন ছোট উদ্যোক্তাকে তিনি দেখতে আসবেন, এটা আমার বড়ই আনন্দের। এ জন্য নিজেকে নিয়ে নিজেই গর্ব করি।’ বলেন ঝর্না ইসলাম।