ফেসবুক লাইভে জামাকাপড় বেচাকেনা, রেস্তোরাঁর মুখরোচক খাবারের ছবি—এমন নানা রকম পোস্টের আড়ালে হঠাৎ চোখ আটকে গেল ‘দ্য রেড ব্যাটেল’ নামের এক প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতায় লড়াই করছে দুই দল। ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যে দল সবচেয়ে বেশি মানুষকে রক্ত জোগাড় করে দিতে পারবে, তারাই হবে বিজয়ী! এটাই এই প্রতিযোগিতার একমাত্র নিয়ম।
ব্যতিক্রমী এই প্রতিযোগিতার আয়োজক একটি ফেসবুক গ্রুপ, নাম ‘রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ’। গ্রুপে ঢুঁ মেরে দেখা গেল রক্তদাতারাই এখানে পোস্ট দিয়ে খুঁজে নিচ্ছেন রক্তের প্রয়োজন এমন রোগীকে। যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরাও পোস্ট দিচ্ছেন।
যোগাযোগ করলাম গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত দেবের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০১৫ সালে শুরু করা এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ২ লাখ ৮৮ হাজার। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। যদিও সুব্রতর এই উদ্যোগের পেছনের গল্পটা ছিল আক্ষেপের। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য আগ্রহী হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরই জানতে পারলেন, ওজন কম বলে তিনি রক্ত দিতে পারবেন না। শুধু তা-ই নয়, ওজন ও ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকদের টিটকারিও সহ্য করতে হলো সুব্রতর। সব মিলিয়ে ভীষণ কষ্ট পেলেন তখন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে যখন চাকরিজীবনে পা দিয়েছেন, তখন হঠাৎ সুব্রতর মনে হলো, আমি রক্ত দিতে না পারি। মানুষকে তো রক্ত দিতে উৎসাহিত করতে পারি।’ এই চিন্তা থেকেই ২০১৩ সালে ডোনেট ব্লাড বিডি (www.donatebloodbd.com) নামের একটি ওয়েবসাইট চালু করলেন। যে ওয়েবসাইটে থাকবে রক্তদানে আগ্রহী রক্তদাতাদের তথ্য। তবে শুরুতে তেমন সাড়া মেলেনি। মাত্র ছয়জন রক্তদাতা সেখানে নিবন্ধন করেছিলেন। এরপর ফেসবুকে জনপ্রিয় আরিফ আর হোসেনের সাহায্য নেন তিনি। আরিফ আর হোসেনকে দিয়ে পোস্ট করানোর পর থেকে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
সাত বছরের ব্যবধানে বর্তমানে এই ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত রক্তদাতা আছেন ৫ হাজার ৭৩ জন। অনলাইন দুনিয়ায় রক্তদাতা ও গ্রহীতাদের কাছে ভরসার ঠিকানা হয়ে উঠেছে ওয়েবসাইটটি। ২০১৫ সালে এই ওয়েবসাইট ঘিরে গড়ে ওঠে রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপটি। ওয়েবসাইট আর গ্রুপ ছাড়াও বর্তমানে বিশেষায়িত কল সেন্টারও পরিচালনা করেন তাঁরা।
রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশের দুই সদস্য নজরুল ইসলাম ও আফসানা নাজনীন—এই দম্পতি মিলে ফোনের ওপার থেকে মানুষকে রক্তদাতা খুঁজে দেন। মজার ব্যাপার হলো, রক্তের প্রয়োজনেই পরিচয় হয়েছিল তাঁদের। সেই পরিচয় থেকেই সংসার বেঁধেছেন তাঁরা। রক্তদাতাদের এমন স্মরণীয় অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করতে ভুল করেননি সুব্রত। এক ব্যাগ মানবতা ও ৫০ মিলিলিটার স্মৃতি শিরোনামে দুটি ই-বুকে রক্তদাতাদের প্রথম রক্তদানের অভিজ্ঞতা ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতার সংকলন করা হয়েছে।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন সুব্রত। নিজের জমানো কিছু অর্থ আর বন্ধুদের সহায়তায় স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠান চালান তিনি। সুব্রত বলেন, ‘কল সেন্টার পরিচালনাকারী দুজন বেতনভোগী কর্মী। আর বাকিরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী।’ তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন তিনি। সমস্যা সমাধানে কয়েকবার তহবিল সংগ্রহের চেষ্টাও করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত সেভাবে সাড়া মেলেনি বলে জানান সুব্রত।