মা কাজ শুরু করেন রাত ১২টায়। শেষ করেন পরের দিন বিকেল ৫টা নাগাদ। মজুরি পান ১৫০ টাকা। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা এভাবে রাতদিন একাকার করে কাজ করেন ধানের চাতালে। প্রখর রোদ পড়লে তিন দিনে ধান শুকিয়ে তুলতে পারেন। তখন দৈনিক মজুরি ১৫০ টাকা থাকে। বৃষ্টি-বাদল বা শীতের সময়ে রোদের তাপ কমে এলে মজুরিও কমে আসে।
তখন তিন দিনের ধান শুকিয়ে তুলতে সময় লাগে পাঁচ দিন বা সাত দিন। মজুরিও কমে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় নামে। যে কাজ করে দুমুঠো ভাত খেয়ে নিজেরই বেঁচে থাকা কঠিন, সেই কাজ করে মা মিনা বেগম (৩৭) তাঁর দুটি ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। বড় ছেলে মিজানুর রহমান এবার এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে মিজানুর রহমান এবার বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। সব বিষয়ে জিপিএ–৫ তো আছেই, প্রতি বিষয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ৮৭ শতাংশের একটু বেশি।
সংসার সংগ্রাম
মিজানুরদের একখানা ঘর আছে বটে, কিন্তু বৃষ্টি এলে ঘরের ভেতরে ছাতা মাথায় বসে থাকতে হয়। মিনা বেগমের স্বামী থেকেও নেই। বড় ছেলে মিজানুর রহমানের বয়স যখন চার বছর, তখন তিনি পাশের গ্রামে গিয়ে আরেকটি বিয়ে করে সেখানেই সংসার পেতেছেন। এক যুগে তিনি একবারের জন্যও স্ত্রী–সন্তানের খোঁজ নেননি। দুই সন্তানকে নিয়ে মা মিনা বেগম পুঠিয়ার ধোপাপাড়া গ্রামে থাকেন।
স্বামী ছেড়ে চলে গেলেও মিনা বেগম হাল ছাড়েননি। দুই শিশুসন্তান নিয়ে তিনি কঠিন জীবনসংগ্রামে নেমে পড়েন। খাবার জোগাড় করার জন্য তিনি জমিতে নিড়ানি, ফসল কাটা এমনকি মাটি কাটার মতো কঠিন কাজও করতে শুরু করেন। তিন বছর হলো তিনি ধোপাপাড়া বাজারের জহুরুল ইসলামের ধানের চাতালে কাজ নিয়েছেন।
৯ মে পুঠিয়ার ধোপাপাড়া গ্রামে গিয়ে ধানের চাতালেই মা মিনা বেগমকে পাওয়া যায়। সেদিন রাজশাহীতে বয়ে যাচ্ছে দাবদাহ। সারা দেশে রাজশাহীর তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ। সাড়ে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই রোদের মধ্যে মিনা বেগম ধানের চাতালে ধান শুকাচ্ছেন। রোদের কথা শুনে বললেন, রোদ হলেই ভালো। তিন দিনের মধ্যে ধানের একটা চালান তোলা যায়। তিন দিনে করতে পারলে দিনে ১৫০ টাকা করে মজুরি পাওয়া যায়। ভালো রোদ না হলে তিন দিনে চালান তোলা যায় না। তখন মজুরি কমে যায়। কারণ, তাঁরা ধান বয়লারে সেদ্ধ করে শুকিয়ে বস্তা ভরে দেওয়ার জন্য বস্তাপ্রতি একটা চুক্তি করে নেন।
মা-ছেলের ঘর
মিজানুরদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনের চালার ছোট্ট একটা খুপরি ঘর। শিলাবৃষ্টিতে টিনের চালা ফুটো হয়ে গেছে। এখন ঘরের ভেতরে রোদ-বৃষ্টি সবই পড়ে। মিনা বেগম জানান, তাঁর স্বামী ছেড়ে চলে গেলেও শাশুড়ি ভিটে থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেননি। শাশুড়ির দুই কাঠা জমি রয়েছে। তাতে তাঁর স্বামী ও দেবরকে দুটি ঘর করে দিয়েছিলেন। তার একটিতে মিনা বেগম দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন।
কীভাবে দুই ছেলেকে মানুষ করছেন বলতে গিয়ে মিনা বেগম কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘সব দিন ছেলেরা পেটপুরে ভাত খেয়ে স্কুলে যেতে পারেনি। ঠিকমতো জামাকাপড় দিতে পারিনি। মিজানুর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পরে একটা স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেই জামাটি নিচের দিকে ছিঁড়ে গিয়েছিল।’ পরের বছর সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর নতুন আরেকটি স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিয়েছেন। সেটি পরেই ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিল। নতুন আর কিছু বানিয়ে দিতে পারেননি। মিনা বেগম বলেন, ‘আমার মতো কষ্ট করে এই গ্রামে কেউ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখায় না।’ নিজে লেখাপড়া না জানলেও যেকোনো মূল্যে ছেলে দুটিকে লেখাপড়া করাবেন। এই তাঁর পণ।
এক ছেলের ভালো ফলের আনন্দে খুশি হবেন, সে সুযোগ আর হলো কই? মিনা বেগম জানালেন, ছোট ছেলে আশিকুর রহমান সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটার টনসিল পেকে গেছে। চিকিৎসক বলেছেন, অস্ত্রোপচার করতে ১০ হাজার টাকা লাগবে। এখন তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন।
মিজানুর রহমান একটু বড় হওয়ার পর ধোপাপাড়া বাজারে তার মামার সবজির দোকান চালায়। এ জন্য মামাবাড়ি থেকে সে তিন বেলা খাবার পায়। মিজানুর বলে, তার মামারাও গরিব মানুষ। এ জন্য আলাদা করে টাকাপয়সা দিতে পারেন না।
কোন কলেজে ভর্তি হবে? মিজানুর রহমান জানায়, অনলাইনে সে ফরম পূরণ করেছে। কোন কলেজে ভর্তি হবে, এখন সেসব ভাবছে না। আবার শহরের কোনো কলেজে হলেও পড়তে পাঠানোর মতো সামর্থ্য তার মায়ের নেই।
ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, ছেলেটা পড়ায় ভালো দেখে তাঁরা উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। স্কুলের বেতন ফ্রি করে দিয়েছেন।