দূর সমুদ্রে একটি বিন্দু দেখেই উৎসুক হয়ে ওঠেন পাড়ে দাঁড়ানো আলোকচিত্রীরা। নিশ্চয় কোনো নৌযান! এদিকে নতুন ছবির আশায় আলোকচিত্রীর দল। ওদিকে নতুন জীবনের আশায় উদ্দাম সাগর পাড়ি দেওয়া একদল রোহিঙ্গা। খানিক বাদে তীরে এসে ভেড়ে সেই নৌযান। আলোকচিত্রীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্যামেরা হাতে। তাঁদেরই একজন কে এম আসাদ। সেদিন এক মায়ের কোলে থাকা শিশুর মুখে খুঁজে পান সব রোহিঙ্গার দুর্দশার ছবি। আসাদের সেই ছবি ইউনিসেফের ২০১৭ সালের বর্ষসেরা ছবির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ঠাঁই পেয়েছে।
২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘ফটো অব দ্য ইয়ার’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা ছবিগুলোকে পুরস্কৃত করে আসছে ইউনিসেফ জার্মানি। সারা পৃথিবী থেকেই ছবি আহ্বান করা হয়। ছবি নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়া হয় শিশুদের সংবাদ। জর্ডানের এক উদ্বাস্তু শিবিরে পাঁচ বছরের জারার কষ্টমাখা মুখের ছবি তুলে ২০১৭ সালের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে দুবার পুলিৎজার জেতা জেরুজালেমের ফটোসাংবাদিক মুহাম্মেদ মুহাইসেন। কানাডীয় আলোকচিত্রী কেভিন ফ্রেয়ারের ছবি হয়েছে তৃতীয়। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ত্রাণের আশায় এক শিশুর লড়াইয়ের ছবি তুলেছেন তিনি।
১৬ জানুয়ারি রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় খোন্দকার মোহাম্মাদ আসাদের সঙ্গে। কে এম আসাদ নামে তিনি বেশি পরিচিত। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে জুমা প্রেস ও গেটি ইমেজের পাশাপাশি আরও কিছু এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত আছেন। পুরস্কার পাওয়া ছবিটি তুলেছিলেন জুমা প্রেসের জন্য। ২০০৫ সাল থেকে সংবাদভিত্তিক ও প্রামাণ্য আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করছেন। আসাদ বলেন, ‘২০০৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে যত বড় ঘটনা ঘটেছে, আমি চেষ্টা করেছি সব জায়গায় যেতে। সেটা সিডর হোক কিংবা রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। তবে রোহিঙ্গা সংকট আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ছিল। একাত্তরের উদ্বাস্তু সংকট সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। কখনো চিন্তা করিনি এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশেও হতে পারে।’
গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে নাফ নদী হয়ে প্রচুর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সে খবর পেয়েই টেকনাফ যেতে চেয়েছিলেন আসাদ। তবে ২ সেপ্টেম্বর ছিল ঈদ। বাড়ির বড় ছেলে ঈদের দিন ঘরের বাইরে থাকবে, তাঁর পরিবার কোনোভাবেই তাতে সায় দেয়নি। আসাদ বলেন, ‘ঈদের পরদিনই আমি কক্সবাজারে যাই। গিয়ে দেখি গোটা পৃথিবী থেকে বড় বড় ফটোসাংবাদিক এসেছেন। সে তুলনায় আমি কিছুই না, আমার নতুন কী করার থাকতে পারে, তা–ই মাথায় ঢুকছিল না।’
কয়েক দিন টেকনাফে কাজ করার পর আসাদ খবর পান, সাগর পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু ঠিক কোন পথে আসে, কিংবা আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবু অন্যান্য ফটোসাংবাদিকের সঙ্গে আসাদও যান শাহপরীর দ্বীপে। আসাদ বলেন, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বিকেলে দূর সমুদ্রে, দৃষ্টির শেষ সীমায় একটা বিন্দু দেখতে পাই। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা নিশ্চিত হই যে সেটা আসলেই একটা নৌযান। তীরে এসে ভিড়লে আমরা সবাই তাঁদের ছবি তুলতে শুরু করি। বিশেষ করে নৌকা থেকে লাফিয়ে নামছে, দৌড়ে যাচ্ছে নতুন জীবনের খোঁজে—এমন ছবি। ঠিক সে সময়ে এক রোহিঙ্গা নারীকে দেখি সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড় থেকে সন্তানকে বাঁচাতে তীরের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। সে শিশুর মুখে যন্ত্রণার ছাপ। শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া সম্ভব—কী হয়েছিল ওপারে। সে সময় আমার মনে হয়েছিল, অন্য কিছু না, সেই মুখাবয়ব, সেই অভিব্যক্তি আমাকে ধারণ করতে হবে। এরপর আমি ছবিটি তুলি।
সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যাওয়া সেই মা ও শিশুর ছবি হয়ে যায় নতুন জীবনের আশায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা শরণার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক।
প্রধান বিচারক ক্লাউস হনেফের কথা
‘ইউনিসেফ ফটো অব দ্য ইয়ার ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন জার্মান শিল্প–সমালোচক অধ্যাপক ক্লাউস হনেফ। ই-মেইলে তাঁর কাছে দুটি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। প্রথমটি ছিল, এবারের প্রতিযোগিতার বিজয়ী এবং সম্মানজনক উল্লেখে (অনারেবল মেনশন) উদ্বাস্তু নিয়ে ছবির প্রাধান্য কেন? ই–মেইলের জবাবে ক্লাউস হনেফ বলেন, ‘ইউনিসেফ ফটো অব দ্য ইয়ার হলো ফটোসাংবাদিকদের প্রতিযোগিতা। শৈল্পিক আলোকচিত্র এর মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ প্রতিযোগীই ফটোসাংবাদিক। অর্থাৎ, সারা বিশ্বে সংবাদ হওয়ার মতো যা ঘটেছে, তা-ই তাঁদের ছবির বিষয়বস্তু। সমকালীন একটি বিষয় হলো তথাকথিত উদ্বাস্তু সমস্যা। আর এটাই তাঁদের জমা দেওয়া ছবিতে ফুটে উঠেছে।’
কে এম আসাদের ছবি সম্পর্কে হনেফ বলেন, ‘এই ছবিতে মৃত্যুভয়ে থাকা মানুষদের উদ্বেগ ও দুর্দশার হৃদয়স্পর্শী প্রতিফলন আছে। এতে অস্তিত্বের সংকট বিষয়টি উঠে এসেছে। এটা নিখাদ ছবি-সংবাদ, এটা “পিকচার অব দ্য ডে”। ছবিটিতে একটি নান্দনিক গুণ আছে।’