অমৃতলোকের অতিথি হয়েছেন সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। চোখ বুজে তাঁর কথা ভাবতে গেলে অনবদ্য সুমিষ্ট কণ্ঠ শুধু নয়, মনে ভেসে ওঠে তাঁর সাদা শাড়ি, লাল টিপ, আধিক্য বিবর্জিত স্মিত হাসি। কণ্ঠের চেয়ে কোনো অংশে কম বিশিষ্ট নয় তাঁর এই অনন্য রূপ। নিতান্তই সাদামাটা এই রূপ দিয়েই তিনি চোখ জুড়িয়েছেন, মন কেড়েছেন সারা জীবন।
সাদায় অনন্যা
‘ভরাব না ভূষণ–ভারে, সাজাব না ফুলের হারে’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এই চরণ দুটি যেন লতার জন্যই লেখা। একেবারে তরুণকাল থেকেই তিনি সাদা, অফহোয়াইট ও বেজ রঙের জমিনের শাড়ি পরে আসছেন। আঁচল ঘুরিয়ে আরেক কাঁধও ঢেকে রাখতেন সব সময়। সুতি বা রেশমি যা–ই হোক, ছোট বা মাঝারি পাড়ের শাড়িগুলো সব সময়ই প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি।
শীতকালে তাঁর গায়ের পশমিনা শালগুলোও ছিল হালকা সাদা। রঙিন সাজপোশাক এড়িয়ে চলার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ২০১৩ সালে ‘বলিউড হাঙ্গামা’র সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন, রঙিন শাড়ি পরায় একবার কোরাসশিল্পীরা বেদম হাসি–তামাশা করেছিলেন। তিনি রেগে গিয়ে শপথ করেছিলেন, অত রংচঙের কিছু পরবেন না। তবে সাদায় তাঁর শান্ত, স্নিগ্ধ আর খাঁটি রূপটি ফুটে ওঠে। আর এটি তাঁর শিল্পীসত্তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। ভারতের প্রখ্যাত সেলিব্রিটি স্টাইলিস্ট ইশা বানসালিও সেটিই মনে করেন। গতানুগতিক ধারা পাশ কাটিয়ে এত বছর ধরে যে নিজের একটি বিশিষ্ট আইকনিক লুক ধারণ করে গেছেন, তা সত্যিই বিরল।
হীরার দ্যুতি মুক্তার ছটা
কখনো তাকে কোনো ভারী গয়না পরতে দেখা যায়নি। কিন্তু হীরার প্রতি ছিল লতা মঙ্গেশকরের দুর্নিবার আকর্ষণ। ২০০৫ সালে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ নিয়ে এক চমৎকার স্মৃতি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম রোজগার থেকে মাকে কিনে দিয়েছিলেন স্বর্ণালংকার। আর নিজের জন্য গড়িয়েছিলেন বিশেষ নকশাখচিত হীরা আর রুবির আংটি, তাতে খোদাই করা ছিল নিজের নামের আদ্যাক্ষর। ১৯৪৭ সালে ৭০০ রুপিতে কেনা সেই আংটি সযত্নে রাখা ছিল আমৃতু৵ তাঁর কাছে। প্রখ্যাত অলংকার ডিজাইনার অর্চনা আগরওয়াল ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, স্টাইল ও লুকের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তিনি বড় একটি জুয়েলারি ব্র্যান্ডের সঙ্গে নিজের নামে হীরার গয়নার কালেকশনও করেছেন। গানের পরেই যে হীরা তাঁর ভালোবাসার জায়গা, অনেককেই তা বলতেন তিনি। তাঁর ছিল হীরার আংটি ও টপের বর্ণাঢ্য সংগ্রহ। মুক্তার কমনীয় ছটার প্রতি ছিল লতার আকর্ষণ। মুক্তার একলহরি মালা বা পুষ্পাকৃতি টপ, পাশা বা এক মুক্তার স্টাডে তাঁর চিরচেনা মধুরিমা আরও বেড়ে যেত যেন।
ন্যূনতাই সুন্দর
বছর আটেক আগে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’–এর সঙ্গে এক আন্তরিক আলাপচারিতায় লতা মঙ্গেশকর বলছিলেন তাঁদের অতি রক্ষণশীল মারাঠি পরিবারের কঠিন অনুশাসনের কথা। তিনি বা তাঁর বোনদের সাজসজ্জার প্রবণতাকে কখনো প্রশ্রয় দিতেন না তাঁর বাবা। ছোটবেলায় হালফ্যাশনের ঘটিহাতা জামা পরে একবার বাবার রোষানলে পড়েছিলেন। আর এমনিতেও লতাকে ফ্যাশন কখনো টানেনি বলেই তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সব সময়। সংক্ষিপ্ত পোশাক বা ভারী মেকআপে কোনো দিনই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি তিনি। তাই তো গড্ডলিকা প্রবাহকে উপেক্ষা করে নিজেকে এক অন্যরকম স্টাইল আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্মিত হাসি, পরিমিত অলংকার, চোখ শীতলকারী জ্যোৎস্নার মতো সাদাটে শাড়ি, লাল টিপ আর দুই বেনির ইন্দ্রজাল। এভাবেই সহজ অমলিন সৌন্দর্যে তিনি হয়ে থাকবেন চিরস্মরণীয়।