বৈশাখ মাসের পর থেকেই আমরা মুখিয়ে থাকি সুস্বাদু সব আম খাবার জন্য। জ্যৈষ্ঠ এলে তো কথাই নেই। গাছে গাছে আম দেখে আমাদের কেবলই মনে হয়, কবে পাকবে এই আম! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কোন জাতের আম কবে পাকবে বা খাওয়ার উপযোগী হবে, সেটা হয়তো জানেন না। আম খেতে গিয়ে, কিনতে গিয়ে তাঁদের অনেকে ভুল করেন।
চলছে মে মাস। এই মাসে আপনারা বাজারে দুটি জাতের আম কিনতে পারবেন। একটি গোপালভোগ অন্যটি গোবিন্দভোগ।
গোপালভোগ: বাংলাদেশে উৎপন্ন অতি উৎকৃষ্ট জাতের আমের মধ্যে অন্যতম গোপালভোগ আম। এটি সবার আগে পরিপক্ব হয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে পরিপক্বতা লাভ করতে শুরু করে এই আম। মে মাসের ২০ তারিখের পর থেকে বাজারে বেশি পরিমাণে আসতে থাকে
এবং জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এ আম আর পাওয়া যায় না। আমটি পাকার পর খুব বেশি দিন বাজারে থাকে না। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে গোপালভোগ বাজারে এসে দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যায়। উৎকৃষ্ট ও পরিপক্ব গোপালভোগ আম কেনার উপযুক্ত সময় মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে জুন মাসের ১০ তারিখের মধ্যে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর ও দিনাজপুর জেলায় গোপালভোগ আম সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলাতেও এ আমের চাষ হয়ে থাকে।
গোপালভোগ আমের জাতটি কবে, কোথায় এবং কাদের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছে কিংবা নির্বাচিত হয়েছে, এ তথ্য এখনো অজানা। তবে ধারণা করা যেতে পারে, মুর্শিদাবাদে নবাবদের বিখ্যাত আমবাগান থেকেই হয়তো এই জাতের উদ্ভব ঘটেছে। আমটি মাঝারি আকৃতির এবং সামান্য লম্বা। অবতল বা সাইনাস অনেকটাই বাঁকানো। শীর্ষদেশ অন্যান্য জাতের আমের তুলনায় অনেক সরু ও গোলাকার। একনজর দেখলেই অন্যান্য জাতের সঙ্গে সহজেই গোপালভোগ আমের পার্থক্য করা যায়। পোক্ত হলে পৃষ্ঠদেশ ও সম্মুখে কাঁধের অংশের খোসায় সাদা সাদা ক্ষুদ্র ফোঁটা পরিলক্ষিত হয়। গোপালভোগ অনেকটা কালচে সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। পাকলে ত্বক হালকা থেকে কিঞ্চিৎ হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে। গোপালভোগ আম সাধারণত গড়ে লম্বায় ৮.৬ সেন্টিমিটার এবং ৬.৪ সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়ে থাকে। এই আমের ওজন ২৩০ গ্রাম থেকে ২৬০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। সম্মুখের কাঁধ সামান্য স্ফীত। খোসা সামান্য মোটা। শাঁস আঁশবিহীন ও রসাল। শাঁসের রং গাঢ় কমলা। ফলটির খাদ্যাংশ ৬০ শতাংশ। মিষ্টতার পরিমাণ ২১/২৩ শতাংশ। গোপালভোগ আমের বোঁটা শক্ত।
নাটোর ও দিঘাপতিয়ার রাজা জমিদারদের নিজস্ব পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা আমবাগানগুলোতে সবচেয়ে উন্নত মানের গোপালভোগ আমের গাছ ছিল বলে জানা যায়। নাটোর জেলায় আমটি স্থানীয়ভাবে ‘কালুয়া’ নামে পরিচিত। উত্তরা গণভবনের (দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী) চত্বরে এখনো বিশালাকারের কয়েকটি কালুয়া (গোপালভোগ) আমের গাছ রয়েছে। এই গাছগুলোর গোপালভোগ বা কালুয়া আমের তুলনা চলে শুধু সেই গাছের ফলগুলোর সঙ্গে। এখান থেকে ডাল (সায়ন) সংগ্রহ করে শত শত কলমের চারা তৈরি হয়েছে। ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বিহার রাজ্য ও উত্তর প্রদেশে গোপালভোগ আম জন্মে থাকে প্রচুর পরিমাণে। ভারতের পশ্চিম বাংলা ও বিহার রাজ্যের কয়েটি জেলায় ‘গঙ্গাসাগর’ নামে আমের একটি উন্নত জাত কালুয়া নামে পরিচিত।
গোপালভোগ আমের গাছে ফল আসে প্রচুর পরিমাণে। তবে এই আমের সংরক্ষণশীলতা অন্যান্য আমের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করে ৩-৪ দিনের বেশি ঘরে রাখা যায় না। ফলটির বোঁটা বেশ শক্ত যে কারণে ঝড় এলে খুব বেশি আম নষ্ট হয় না। মুকুল আসা থেকে শুরু করে পরিপক্ব হতে মোট চার মাস সময় নিয়ে থাকে এই আম। গোপালভোগ আম বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সফল। ভরা মৌসুমে আমের বাজারে গোপালভোগ আম প্রতি কেজি ২৫/৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। রাজশাহী মহানগরীতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গোপালভোগ আম নারীদের কাছে অধিকতর পছন্দের।
গোবিন্দভোগ: বাংলাদেশে অতি আশু জাতের আমের মধ্যে গোবিন্দভোগ অন্যতম। উৎকৃষ্ট জাতের এই আম সাতক্ষীরা জেলায় সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয়। গোবিন্দভোগ আম মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে। আর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এটি পাকতে শুরু করে। এই আম কেনার উপযুক্ত সময় ১৫ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত।
একেকটি গোবিন্দভোগ আমের ওজন ৩৩০ গ্রাম থেকে শুরু করে ৪১৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাকার পর ফলটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আমটি দেখতে অনেকটা হিমসাগর আমের মতো, তবে আকারে হিমসাগরের চেয়ে বেশ বড় ও লম্বাটে। চওড়ার দিকটায় চ্যাপ্টা ধরনের। গোবিন্দভোগ ভালো স্বাদের এবং রসাল আম। এর মিষ্টতার পরিমাণ ২২ শতাংশ।
গোবিন্দভোগ আমটি এসেছে ভারতের নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ এলাকা থেকে। ব্রিটিশ সময়ে সাতক্ষীরা (২৪ পরগনা জেলার অধীনে মহকুমা ছিল) এলাকার টাউন শ্রীপুরের (বর্তমানে দেবহাটা থানা) জমিদারগণ শখ করে ভালো জাতের আমের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। এর মধ্যে গোবিন্দভোগ আমের চারাও ছিল। টাউন শ্রীপুর থেকে জাতটি ছড়িয়ে গেছে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, তালাসহ সব এলাকায়। আমটির আকার বড় এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় বর্ণের, তদুপরি মৌসুমের শুরুতেই পাওয়া যায়। এসব কারণে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাজারে আমটির বেশ কদর। বেশি দিন বাজারে দেখা মিলবে না। মে মাস শেষ হতে না–হতেই আর পাওয়া যাবে না। ফলটির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লেখক: নদী ও স্থানীয় ইতিহাসবিষয়ক গবেষক।
আরও পড়ুন: