বই পড়ার অনেক উপকারিতা। কিন্তু বই পড়লে যে আয়ুও বাড়ে, এটা কি জানতেন? জানাল ‘দ্য সারভাইবাল অ্যাডভান্টেজ অব রিডিং বুকস’ শীর্ষক এক গবেষণা। ১২ বছর ধরে চলা এ গবেষণা বলছে, বই পড়ুয়ারা অন্য বিনোদনভোক্তাদের চেয়ে দুই বছর বেশি বাঁচেন। দৈনিক নিয়মিত অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়েন, এমন মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অপড়ুয়াদের থেকে ২৩ শতাংশ বেশি।
বই পড়া যে খুব ভালো অভ্যাস—এ বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবু বই পড়তে আমাদের বড় অনীহা। বহু আগে প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন, বই পড়ার লাভ নগদে হাতে হাতে পাওয়া যায় না বলে লোকে বই পড়তে চায় না।
তার মানে, বই জীবনে খুব একটা অর্থকরী নয়। কেউ কেউ বলবেন, অর্থনাশী। বই কিনতে টাকা লাগে। অনেকে বলেন, বইয়ের যা দাম! এর উত্তর সৈয়দ মুজতবা আলী দিয়ে গেছেন, ‘কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার কিউ থেকে?’
তবে অর্থ বলতে তো কেবল টাকা নয়, বাংলায় ‘অর্থ’ শব্দটির আরেকটি অর্থও আছে। অর্থকরী না হোক, জীবনকে অর্থবহ করতে বই পড়ার বিকল্প খুব একটা নেই। এমন সফল মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি নিয়মিত বই পড়েন না। গবেষণা বলছে, বই পড়ার অভ্যাস যেমন জীবনকে সফল করে, তেমনি জীবনের দৈর্ঘ্যও বাড়িয়ে দেয়।
বই পড়লে বেশি বাঁচা যায়—কথাটা দুটো অর্থে সত্য। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যাঁরা নিয়মিত বই পড়েন, তাঁরা অপড়ুয়াদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচেন। আবার অন্যদিক থেকে এ তো চিরন্তন সত্য, যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা জীবনকে আরও বড় জায়গা থেকে দেখতে পান। গড়পড়তা মানুষের থেকে তাঁরা জীবনকে বেশি উপভোগ করতে পারেন, অর্থাৎ বেশি বাঁচেন।
বই শরীর-মন সুস্থ রাখে
যখন আপনি নিয়মিত বই পড়েন, তখন আপনার মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হয়। ফলে মস্তিষ্ক সচল থাকে। মস্তিষ্কের যে ক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে, সেটির একধরনের চর্চা হয়। একটি গবেষণা বলছে, এর ফলে আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়ার মতো রোগ থেকে মস্তিষ্ক সুরক্ষিত হয়।
শরীরের সব অংশের মতোই মস্তিষ্কেরও ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে। বই পড়লে মস্তিষ্কের সেই ব্যায়ামের চাহিদা মেটে। এ ছাড়া নানা রকম মানসিক চাপ থেকেও বই আমাদের দূরে রাখে। বই পড়ার অভ্যাস আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। যদি আমরা কোনো বড় উপন্যাস পড়ি, তাহলে মস্তিষ্ক বাধ্য হয় উপন্যাসের নানা চরিত্রের নাম ও তাদের বৈশিষ্ট্য মনে রাখতে। মনে রাখতে হয় উপন্যাসে তাদের বিবিধ যাত্রাপথ।
যখন আপনি একটি ভালো গল্প পড়েন, তখন আশপাশের সব রকম চাপ থেকে এটি আপনাকে মুক্তি দেয়। মনকে শান্ত করে। মানসিকভাবে অন্য জগতে পৌঁছে দেয়। আর এই আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার সময় এমন কোনো উপদেশ বা সমাধানের খোঁজও হয়তো পাওয়া যায়, যা যেকোনো সমস্যাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে সাহায্য করে, তাকে সমাধানের পথে নিয়ে যায়।
যাঁরা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্য বই পড়ার অভ্যাস লাভদায়ী হতে পারে। মানসিক অবসাদ থেকে মুক্ত থাকতেও বই আমাদের সাহায্য করে। যাঁদের অনিয়মিত ঘুমের সমস্যা আছে, তাঁরা নিয়মিত বই পড়লে লাভবান হবেন। ঘুম ভালো হবে।
বই আয়ু বাড়ায়
বই পড়ার অভ্যাস শরীর-মন সুস্থ রাখতে কাজে লাগে। স্বাভাবিকভাবে এর ফলেই মানুষের আয়ু বাড়ার কথা। তবে এখন আর শুধু অনুমান নয়, রীতিমতো গবেষণা করেই এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১২ বছর ধরে চলা ‘দ্য সারভাইবাল অ্যাডভান্টেজ অব রিডিং বুকস’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা সাধারণত যাঁরা বই পড়েন না বা বিনোদনের জন্য অন্য কোনো মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাঁদের থেকে প্রায় দুই বছর বেশি বাঁচেন।
একই সঙ্গে দেখা গেছে, যাঁরা দৈনিক নিয়মিত অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়েন, তাঁদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অপড়ুয়াদের থেকে ২৩ শতাংশ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং তাই আয়ু বাড়াতে নিয়মিত বই পড়ার পরামর্শ দিয়েছে।
আত্মোন্নয়নে বই
বেশির ভাগ সফল মানুষ, যাঁরা জীবনে বড় হয়েছেন, দেশ ও দশের জন্য কিছু করেছেন, নিজ নিজ কর্মজীবনে চূড়ান্ত সাফল্যের দেখা পেয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবারই বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে। আব্রাহাম লিংকন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা ওয়ারেন বাফেট থেকে জ্যাক মা—নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল এসব মানুষ বই পড়াকে করেছেন দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ।
কিন্তু কেন তাঁরা বই পড়াকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন? এর প্রধান কারণ, বই পড়ার মাধ্যমেই তাঁরা নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এমন সব বইয়ের সংস্পর্শে তাঁরা নিয়মিত থেকেছেন, যাতে প্রতিটি দিন নতুন কিছু তাঁরা জানতে পারেন, উপলব্ধি করতে পারেন। বই পড়ার অভ্যাস তাঁদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। তাঁদের উন্নত থেকে উন্নততর করেছে।
বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। মনে আরও নানা রকম প্রশ্নের উদয় হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, অন্য কিছুতে মনকে বিক্ষিপ্ত হতে দেয় না। এভাবেই জ্ঞানের চর্চা হয়।
আদিম গুহাবাসী মানুষ যে আজকের সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে মানুষ জ্ঞানের চর্চা করেছে বলেই। আর সেই জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে বইয়ের মাধ্যমে। সেই বই পড়ে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে আরও নতুন জ্ঞান। সভ্যতার বিকাশ হয়েছে এভাবেই।
তাই বই পড়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কী বই আমরা পড়ছি। আমাদের জানতে হবে, কোন ধরনের বই আত্মোন্নয়নে সহায়ক হবে। এগুলো হলো সে ধরনের বই, যা আমাদের আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানতে ও একে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে। যেকোনো সফল মানুষের প্রিয় বইয়ের তালিকা দেখলেই ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।