ওই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। নীলাম্বরকে বলেছিল বিরাজ। পাতে রোজ রোজ একই খাবার তুলে দিতে নারাজ শরৎচন্দ্রের বিরাজবৌ। কে জানত শত বছর পর স্মার্টফোনের নামে ব্যবহারকারীর পাতে ঘুরেফিরে ওই থোড় বড়ি আর খাড়াই তুলে দেবে রাজ্যের কোম্পানিগুলো।
ভিভো তবু একটু আলাদা। প্রথমে আনল পপআপ সেলফি ক্যামেরার ফোন। ওপরের দিক থেকে সাড়ম্বরে ক্যামেরা বেরিয়ে আসে। দেখতে ভালোই লাগে। ছবি তোলা বাদ দিয়ে দিনমান ক্যামেরার ওঠানামা দেখি। এবার এনেছে ‘বিশ্বের প্রথম’ ডুয়েল পপআপ ক্যামেরার ভিভো ভি১৭ প্রো। মানে সেলফি মোডে গেলেই ওপর থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে আসবে জোড়া ক্যামেরা। কে জানে, নিন্দুকেরা এবার হয়তো বলবেন, ওই থোড় থোড়-বড়ি বড়ি-খাড়া খাড়া।
একনজরে
নিন্দুকদের কথায় কান না দিয়ে আমরা বরং ফোনে নজর দিই। ৩ অক্টোবর রাতে দেশের বাজারে ভি১৭ প্রো ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বেশ জাঁকালো অনুষ্ঠান। বেশ কিছু সুবিধার উল্লেখ করে ভিভো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডিউক বলেন, ফোনটি ব্যবহারকারীদের অনন্য অভিজ্ঞতা দেবে। দেখা যাক, কেমন সেই অভিজ্ঞতা।
ভি সিরিজের স্মার্টফোনগুলো মধ্যম সারির হলেও ফিচারসমৃদ্ধ। ভি১৭ প্রোকে বলা যেতে পারে ভি১৫ প্রোর পরবর্তী সংস্করণ। দুটি ক্যামেরা যোগ করার জন্য পপআপ অংশটা বড় করা হয়েছে। সেখানে আরও আছে ফ্ল্যাশলাইট। পেছনে ৪৮ মেগাপিক্সেল লেন্সের মূল সেন্সরসহ মোট চারটি লেন্স থাকছে। এই ছয় ক্যামেরার কথাই বারবার বলছে ভিভো। সন্দেহ নেই এই ক্যামেরাগুলোই স্মার্টফোনটির মূল আকর্ষণ। তা ছাড়া ৮ গিগাবাইট র্যাম আর ১২৮ গিগাবাইট অভ্যন্তরীণ মেমোরির (রম) সঙ্গে থাকছে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ৬৭৫ চিপসেটের আট কোরের প্রসেসর। ৪ হাজার ১০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি দিনভর ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট। আর সামনের পুরোটায় থাকছে ৬ দশমিক ৪৪ ইঞ্চি ডিসপ্লে। বেজেল (পর্দার বাইরের অংশ) বেশ চিকন।
দুটি রঙে বাজারে এসেছে ভি১৭ প্রো। ভিভোর ভাষায়, গ্লেসিয়ার আইস ও মিডনাইট ওশান। সহজ করে বললে সাদা আর কালো। অবশ্য একরঙা বললে ঠিকভাবে বলাও হয় না। পর্যালোচনার (রিভিউ) জন্য আমরা পেয়েছিলাম গ্লেসিয়ার আইস সংস্করণটি। নকশা খারাপ লাগেনি। দাম ৩৯ হাজার ৯৯০ টাকা। একটু বেশি মনে হতে পারে। তবে ফোনে বেশ একটা ‘প্রিমিয়াম’ ভাব আছে।
ক্যামেরা
আগেই বলেছি, মূল আকর্ষণ হলো ক্যামেরা। যোগ করার দক্ষতা প্রমাণ করতে ভিভো বারবার ‘ছয় ক্যামেরার ফোন’ বলছে। সামনের ক্যামেরায় মূল লেন্সটি ৩২ মেগাপিক্সেলের। পপআপ ক্যামেরায় এটিও বিশ্বে প্রথম। সঙ্গে আছে ৮ মেগাপিক্সেলের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স। এতে সেলফি তোলার সময় ছবির ফ্রেম বড় পাওয়া যায়।
পেছনে চার লেন্সের ক্যামেরা। ভিভো বলছে, এআই কোয়াড ক্যামেরা। মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিষয়বস্তু বুঝে ছবির মান উন্নত করার ব্যবস্থা রয়েছে। ৪৮ মেগাপিক্সেলের মূল লেন্সটিই ব্যবহার করা হয় বেশি। তবে পুরো ৪৮ মেগাপিক্সেল ছবি তুলতে চাইলে ক্যামেরার ‘মোর’ অপশনে গিয়ে তা নির্বাচন করে দিতে হয়। দূরের ছবি তুলতে চাইলে আছে দ্বিগুণ জুমের ১৩ মেগাপিক্সেল টেলিফটো লেন্স। আরও আছে ৮ মেগাপিক্সেল সুপার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স এবং ২ মেগাপিক্সেল ডেপথ সেন্সর। এই সেন্সরের কাজ হলো ছবির বিষয়বস্তুর মধ্যে দূরত্ব নির্ণয়। যেমন ছবির পট ঘোলা করার ক্ষেত্রে ক্যামেরাকে ডেপথ সেন্সরের সাহায্যে বুঝতে হয় ছবির কোন অংশটি কোনটির সামনে রয়েছে।
স্মার্টফোনটি দেশের বাজারে ছাড়ার সপ্তাহও পেরোয়নি এখনো। এত দ্রুত উপসংহার টানা ঠিক হবে না। তবে আলো ভালো হলে চমৎকার ছবি পাওয়া যায় ভিভো ভি১৭ প্রোর ক্যামেরায়। কম আলোয় নাইট মোড ব্যবহার করতে পারেন। অটো ফোকাস ও ম্যাক্রো মোড চমৎকার। তবে কোন অংশ ফোকাসে থাকবে আর কোনটি নয়, মানে বোকাহ আবহ যোগ করার বেলায় বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় পেছনের ক্যামেরা যথেষ্ট ভালো। ছবি প্রাণবন্ত। কৃত্রিমতা কম। তবে স্মার্টফোনটির বিশেষত্ব সেলফি মোডে। মানে সামনের ক্যামেরায়।
ব্যাটারি
বড় পর্দার স্মার্টফোনের যে নতুন ধারা চলছে, তার একটি ভালো দিক হলো ব্যাটারিও বড় হয়। তবে ব্যাটারি বড় হলেই যে চার্জ বেশিক্ষণ থাকবে, তেমনটি কিন্তু নয়। অপটিমাইজেশন, মানে স্মার্টফোনের যন্ত্রাংশ, অপারেটিং সিস্টেম এবং অন্যান্য অ্যাপের ব্যবহারে যেন ব্যাটারি খরচ পরিমিত হয়, তা–ও খেয়াল রাখতে হয় উৎপাদনকারীদের। সেদিক থেকে স্মার্টফোনটির ৪ হাজার ১০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি ভালোই কাজে দিচ্ছে। পরীক্ষা করার জন্য পর্দার উজ্জ্বলতা কমিয়ে ইউটিউবে ভিডিও চালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে উঠে দেখি দিব্যি চলছে।
তা ছাড়া দ্রুত চার্জ করার সুবিধা আছে এতে। ১৮ ওয়াটের চার্জার সঙ্গেই দেওয়া থাকে। ব্যাটারির বার শূন্য থেকে শতকে পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েকের মতো লাগে।
ডিসপ্লে
পপআপ ক্যামেরা থাকায় ডিসপ্লের মধ্যে নচ বা এ ধরনের অতিরিক্ত অংশ যোগ করার প্রয়োজন পড়েনি। সে কারণেই ৬ দশমিক ৪৪ ইঞ্চি আলট্রা ফুলভিউ ডিসপ্লে বলা হয়। পর্দার রেজ্যুলেশন দৈর্ঘ্যে ২ হাজার ৪০০ এবং প্রস্থে ১ হাজার ৮০ পিক্সেল। অনুপাতের হিসাবে ২০: ৯। সুপার অ্যামোলেড প্রযুক্তির ডিসপ্লে। যথেষ্ট উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত। কড়া রোদেও দেখতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
নকশা
নকশার কথায় আবারও পপআপ ক্যামেরার উল্লেখ করতে হয়। এতে ডিসপ্লে কাটাছেঁড়া করতে হয়নি। আর পেছনের দিকটা কাচের তৈরি হওয়ায় দেখতে ভালোই লাগে। তবে বিশেষত্ব নেই। অন্যান্য ফোনের মতোই। আরেকটা বিষয় হলো গ্লেসিয়ার আইস সংস্করণটি নিয়মিত ব্যবহারের ফলে দৃশ্যমান আঙুলের ছাপ কিছুটা দৃষ্টিকটু। অবশ্য ব্যাক কভার ব্যবহার করতে পারেন। কেনার সময় বক্সের ভেতরেই একটি পাবেন।
স্মার্টফোনটিতে মোট চারটি বোতাম। ডানে পাওয়ার বোতামের সঙ্গে আছে ভলিউম কমানো–বাড়ানোর সুবিধা। বাঁয়ের বিশেষ বোতামটি মূলত গুগলের ভার্চ্যুয়াল সহকারীর জন্য। তবে তা বদলানোর সুযোগ আছে। নিচে সিম ও মেমোরি কার্ড স্লট, মাইক্রোফোন, ইউএসবি-সি পোর্ট ও স্পিকার। ওপরেও একটি মাইক্রোফোন আছে। সঙ্গে পপআপ ক্যামেরা এবং তার ডানে ৩ দশমিক ৫ মিলিমিটার অডিও জ্যাক। ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর পর্দাতেই আছে। ফলে, পেছনে চারটি ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইট থাকছে।
ফোনটি বেশ ভারী। নিচের তুলনায় ওপরের দিকটা বেশি। মানে ভার সমবণ্টন হয়নি। এক হাতে ব্যবহারের জন্য এটা সমস্যা বলে মনে হয়েছে। অভ্যস্ত হলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
পারফরম্যান্স
৮ গিগাবাইট র্যাম ও ১২৮ গিগাবাইট রমের সঙ্গে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ৬৭৫ প্রসেসর দৈনন্দিন কাজের জন্য যথেষ্ট। তবে এই একই প্রসেসর আগেও ব্যবহার করেছে ভিভো। নতুন ফোন হিসেবে উন্নত প্রসেসর আসা করেছিলাম। তবে অ্যাসফাল্ট ৯ খেলতে তেমন সমস্যা হয়নি। গ্রাফিকস পারফরম্যান্স নিয়ে একটু আপত্তি থাকতে পারে। আনতুতু বেঞ্চমার্ক টেস্টও সে কথাই বলছে। অ্যাপটিতে ভারী কিছু কাজের মাধ্যমে ফোনের সেন্ট্রাল প্রসেসর, গ্রাফিক প্রসেসর, মেমোরি ও ইউজার ইন্টারফেস পরীক্ষা করে দেখা হয়। ত্রিমাত্রিক ছবি কিছুটা আটকে আটকে চলতে দেখা গেছে। স্ট্রেস টেস্টের সময় কিছুটা গরম হলেও সেটুকু হতেই পারে। অপারেটিং সিস্টেম, ইউজার ইন্টারফেস এবং বাদবাকি পারফরম্যান্স সন্তোষজনক।
শেষ কথা
ক্যামেরা, নকশা ও ডিসপ্লে দুর্দান্ত। চিপসেট উন্নত হতে পারত। ওজনের সমবণ্টনের বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত ছিল। একবাক্যে বললে, ক্যামেরার জন্য কিনতে পারেন।