মেরিনা মাহাথিরের আমন্ত্রণে

প্যানেল আলোচনায় অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মঞ্চে বসা সাকিয়া হক (বাঁ থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
প্যানেল আলোচনায় অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মঞ্চে বসা সাকিয়া হক (বাঁ থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত

‘আরে, তুমি তো একদম তরুণ প্রাণ, আমি তো ভেবেছিলাম একজন বয়স্ক মানুষ হবে!’

প্রথম সাক্ষাতে মেরিনা মাহাথির এভাবেই বলে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে ই-মেইল আদান–প্রদান হয়েছে কয়েকবার, পরিচয় বলতে ওটুকুই। তাই হয়তো আমাকে ধারণা করে নিয়েছিলেন একজন রাশভারী, মধ্যবয়স্ক মানুষ হিসেবে।
সেই আচমকা ই-মেইলের কথা বরং কিছুটা বলা যাক। এ বছরের জুন মাসের কোনো একদিনের কথা। একটা ই-মেইল পেলাম, প্রেরকের নাম মেরিনা মাহাথির। নামের শেষ অংশটা কেমন চেনা চেনা লাগল, কিন্তু চট করে মনে পড়ল না! পুরো মেইল পড়ার পর বুঝতে বাকি রইল না, তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মেয়ে। একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মেয়ের ই-মেইল, উচ্ছ্বাসটাই ছিল অন্য রকম।
পরে জানলাম, মেরিনা মাহাথির সমাজকর্মী ও লেখক। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করেন। তিনি জাফিগো নামে একটি সংগঠনের প্রধান। এশীয় নারী পর্যটকদের সংকোচহীন ভ্রমণে এগিয়ে নিতেই তাঁর এই উদ্যোগ। আমি ও আমার বন্ধু মানসী সাহা মিলে নারীদের ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করতে এমন একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেছি কয়েক বছর আগে। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ নামের সেই সংগঠনের সঙ্গে সারা দেশে এখন প্রায় ২৫ হাজার নারী যুক্ত।
এই সংগঠনের কথা মেরিনা মাহাথির জানেন। তাই মেইলে তিনি লিখেছিলেন, কুয়ালালামপুরে জাফিগোর বার্ষিক আয়োজনে আমাকে তিনি বক্তা হিসেবে চান।
৮ নভেম্বর সেই আমন্ত্রণে গিয়েই পরের দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা। আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাঁর হাতে আমাদের প্রকাশনা ভ্রমণকন্যা তুলে দিলাম। আয়োজনের নাম ‘জাফিগোএক্স’। কুয়ালালামপুরে ৯-১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সেই আয়োজনে প্রায় ১৫টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। নানা পর্বে তাঁরা নিজেদের কথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।
তাঁদের সবার গল্পই ছিল প্রেরণাদায়ক। কাকে বাদ রেখে, কার কথা বলব। ক্লায়ার ম্যাকফার্লেন। জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। বড় হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। ফ্রান্সের প্যারিসে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ৩৮ বছর বয়সী এই নারী দুর্বিষহ সেই ঘটনার পর নিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ফুট স্টেপ টু ইন্সপায়ার’ নামের প্রতিষ্ঠান। ধর্ষণের শিকার নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কাজ করেন।
আবার আনিতা ইউসুফ। মুসলিম মালয়েশীয় নারী হিসেবে সারা বিশ্বে বাইক নিয়ে ঘুরছেন। তাঁর জীবনের গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে উৎসাহব্যঞ্জক সব ঘটনা। একেকজন মানুষ একেকভাবে উদ্বুদ্ধ করলেন।

মেরিনা মাহাথিরের সঙ্গে সাকিয়া হকসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা

আমারও সুযোগ হয়েছিল তিনটি পর্বে কথা বলার। কর্মশালা করানোর। তবে বক্তৃতা পর্বটা আলাদাভাবে মনে থাকবে। কারণ আগের দিনই মঞ্চ দেখে এসেছিলাম। বিশাল মঞ্চ। একটু ভয় লাগছিল তখন। মনে হচ্ছিল তুলে ধরতে পারব তো বাংলাদেশকে?
তবে ১০ নভেম্বরের বক্তৃতা পর্বের ২০ মিনিট কীভাবে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বাংলাদেশ নিয়ে বললাম, আমাদের সংগঠন ভ্রমণকন্যা নিয়ে বললাম, এই সংগঠনের কর্মসূচি ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ নিয়েও কথা বললাম। বক্তৃতার পর অনেকেই ছবি তোলার জন্য এগিয়ে এলেন। একজন তো অটোগ্রাফ চেয়ে বসলেন। সংকোচে তাঁকে অটোগ্রাফ দিলাম।
বাংলাদেশকে এভাবে উপস্থাপন করতে পেরে কেমন যেন খুশি খুশি লাগছিল। সবাই অবাক হচ্ছিলেন, আমার বয়স ২৫ বছর জেনে। কারণ, সেখানে আমন্ত্রিতরা সবাই বয়সে বড়।
মাত্র কয়েক দিনে এই মানুষেরা কতটা আপন হয়ে উঠেছেন, ঢাকায় ফিরে বুঝতে পারছি। হয়তো বা কখনো দেখা হবে না তাঁদের সঙ্গে; কিন্তু এই আয়োজনের কথা মনে থাকবে সারা জীবন।
লেখক: সংগঠক, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ