মুহূর্তে তাপের খবর বলে যে যন্ত্র

প্লাস্টিক স্ট্রিপ থার্মোমিটার। ছবি: রয়টার্স
প্লাস্টিক স্ট্রিপ থার্মোমিটার। ছবি: রয়টার্স

থার্মোমিটারের সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন মানুষ নেই বললেই চলে। অসুস্থতা বোধ করলে প্রথম যে জিনিসটির খোঁজ পড়ে, তা হলো ডাক্তারি থার্মোমিটার। আধুনিক সভ্যতা থেকে অনেক দূরে সেই আমাজনের গহিন বনে বসবাসকারীরাও এ ক্ষুদ্র যন্ত্রটির সঙ্গে পরিচিত। বলা চলে, প্রায় ঘরে ঘরে এটির দেখা পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চ প্রযুক্তির কল্যাণে চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নানা রকম অত্যন্ত উন্নত মানের যন্ত্রপাতি। তারপরও মানবদেহের তাপমাত্রা নির্ণয় করার থার্মোমিটার আজও বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়। পৃথিবীব্যাপী অতিক্ষুদ্র এবং অতি ভয়াবহ করোনাভাইরাস তাণ্ডব চালাতে শুরু করলে যত্রতত্র থার্মোমিটারের ব্যবহার বেড়ে গেছে। তবে আজকালকার ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারের চেহারা সব সময় এমন ছিল না।

ইতিহাস 
জানা যায়, ৩৭০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে, সেই হিপোক্রেটিসের সময় থেকে শরীরে ব্যাধি বাসা বেঁধেছে কি না, তা নির্ণয় করতে গিয়ে চিকিৎসকেরা তাঁদের হাত স্পর্শ করে শরীরের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ প্রথম শরীরের তাপমাত্রা বোঝার বা মাপার যন্ত্র বলে কিছু ছিল না, ছিল হাত।

এরপর যাঁর নাম করা যায়, তিনি হলেন ইতালির গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি ১৫৯৩ সালে তাপমাত্রা পরিমাপ করার জন্য থার্মোস্কোপ নামের একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। এ যন্ত্রে কোনো স্কেল ছিল না। শুধু উষ্ণতা বাড়ছে না কমছে, সেটুকু বুঝে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তবে তাঁর উদ্ভাবিত থার্মোস্কোপের পথ ধরেই বর্তমান ধারার থার্মোমিটারের আবির্ভাব ঘটেছে।

ইতালিয়ান বিজ্ঞানী চিকিৎসক সান্তোরিও সান্তোরিও ১৬১২ সালে প্রথম থার্মোমিটার উদ্ভাবন করেন এবং ক্রিশ্চিয়ান হিউজেনস তাতে স্কেল জুড়ে দেন। এ ছাড়া তিনি পানির হিমাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক নির্ণয় করেছিলেন।

তবে ১৭১৪ সালে আধুনিক থার্মোমিটার উদ্ভাবনের কৃতিত্ব নিয়েছেন জার্মান চিকিৎসক ডেনিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট। তিনিই প্রথম থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে পারদ অন্যান্য তরলের তুলনায় অনেক দ্রুত প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। তিনি ১৭২৪ সালে নিজের নামানুসারে ‘ফারেনহাইট স্কেল’-এর প্রবর্তন করেন। মানবদেহের তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে তাঁর স্কেল ছিল ১০০ ডিগ্রি পর্যন্ত দাগ কাটা। পরে কমিয়ে এনে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট করা হয়। সুইডিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডারস সেলসিয়াস ১৭৪২ সালে সেন্টিগ্রেড স্কেলটি পুনঃ প্রবর্তন করেছিলেন, তবে উনিশ শতকের পরেই চিকিৎসকেরা এটি বেশি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন।

বিজ্ঞানী চিকিৎসক সান্তোরিও সান্তোরিও (১৫৬১-১৬৩৬)। ছবি: উইকিপিডিয়া

মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা
জার্মান চিকিৎসক কার্ল অগাস্ট ওয়ান্ডারলিচ ১৮৬৮ সালে মানবদেহের ‘স্বাভাবিক তাপমাত্রা’ ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বলে প্রথম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেন। সে সময়ে তিনি ২৫ হাজার রোগীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন। স্থান, শারীরিক অবস্থা ও সময়ভেদে কিছুটা তারতম্য ঘটতে পারে।

সাধারণত শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হচ্ছে ৩৬.৫-৩৭.৫ সেন্টিগ্রেড বা ৯৭.৭-৯৯.৫ ফারেনহাইট। প্রাপ্তবয়স্কদের দেহের তাপমাত্রা যদি ১০৩ ফারেনহাইট (৩৯.৪°সেন্টিগ্রেড) হয়, তাহলেও উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। মানবদেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ঘর ছাড়িয়ে গেলে তাকে জ্বর (পাইরেক্সিয়া) বলে। যাহোক, আজ আমরা প্রায় সবাই জানি যে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হলেই সতর্ক হতে হবে। অথচ সে সময়ে তা ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

স্যার টমাস ক্লিফোর্ড অলব্যাট (১৮৩৬-১৯২৫)। ছবি: উইকিপিডিয়া

চিকিৎসাশাস্ত্রে থার্মোমিটারের প্রথম ব্যবহার

ইংরেজ চিকিৎসক স্যার টমাস ক্লিফোর্ড অলব্যাট ১৮৬৭ সালে মানব শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য প্রথম ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার উদ্ভাবন করেছিলেন। এটি সহজেই বহনযোগ্য, দৈর্ঘ্যে ৬ ইঞ্চি এবং মানব শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয়ে ৫ মিনিট সময় নিত। ওয়ান্ডারলিচের উদ্ভাবিত থার্মোমিটার ছিল এক ফুটের মতো লম্বা, আর সঠিক তাপমাত্রা নির্ণয় করতে সময় লেগে যেত ২০ মিনিট।

এসব থার্মোমিটার বগলের বা জিভের নিচে, পায়ুপথে এবং ১৯৮৪ সালের দিকে কানে ঢুকিয়ে মানবদেহের তাপমাত্রা নির্ণয় করতে হতো।

থার্মোমিটার পরিবারে সর্বশেষ সংযোজন ‘প্লাস্টিক স্ট্রিপ’ ও ‘কপাল থার্মোমিটার’। এগুলো শরীর স্পর্শ না করেই তৎক্ষণাৎ বলে দেবে দেহের তাপমাত্রা। ধমনির তাপমাত্রা নির্ণয় করতে ইনফ্রারেড অর্থাৎ অবলোহিত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। শরীরের তাপমাত্রা এলসিডি পর্দায় ভেসে ওঠে। এই সঙ্গে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরও বলে দেবে শরীরের তাপমাত্রা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইত্যাদিতে বসানো হয়েছে শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। দূর থেকে বলে দেবে যাত্রীদের দেহের তাপমাত্রা।

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ব্যবহৃত ফারেনহাইট থার্মোমিটার। ছবি: গ্যালিলিও জাদুঘর, ফ্লোরেন্স, ইতালি।

সংক্রামক রোগে দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। বর্তমানে যেকোনো সংক্রমণে সন্দেহের তিরটি চলে যায় সোজা করোনাভাইরাসের দিকে। তাই অনেক অফিস-আদালতে, যাত্রা পথে আরেকটি বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করা হয়। আর তাতে যে থার্মোমিটারটি ব্যবহার হয়, সেটি আজকের চেহারায় পৌঁছাতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে এবং যন্ত্রটি ক্ষুদ্র হলেও ইদানীং এর কদর বেড়েছে বহুগুণ।