স্টেশনে ঢুকে দেখি প্ল্যাটফর্মে শুধু একটা ট্রেন আছে, তা—১৫–২০ মিনিট পর ছাড়বে। বাইরের যানজটের কারণে হয়তো ট্রেনের ভেতর পা ফেলার জায়গাও নেই। ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে মুঠোফোন চালাতে চালাতে অপেক্ষা করতে লাগলাম ট্রেন ছাড়ার। ছাড়লেই লাফ দিয়ে ঠেলেঠুলে উঠে যাব। ১০ মিনিট অপেক্ষার পর ট্রেন ছাড়ল আর আমি মুঠোফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে আরও ২০ জন মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনের কামরায় উঠলাম।
কামরায় উঠে একটু জায়গা করে নিয়েই অভ্যাসবশত আমার হাত চলে গেল প্যান্টের পকেটে। হাত দিয়েই বুক ধক করে উঠল। আমার মুঠোফোন গায়েব। ট্রেনে ওঠার আগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুঠোফোন চালানোর সময়ই হয়তো কোনো পকেটমারের চোখ পড়েছিল। আমার কিছুই করার ছিল না। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম ট্রেনের দরজা ধরে। তবে এটিই আমার মুঠোফোন চালানোর শেষ কাহিনি নয়! ১৫ দিন মুখ কালো করে বাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর পর, মায়ের কাছে ফোন কিনে দেওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করার পর বাবা নতুন মুঠোফোন কিনে দিলেন। বেশ দামি, বেশ উন্নত মুঠোফোন।
আমার খুশি আর দেখে কে! আবার ফিরে গেলাম পুরোনো সেই দিন–রাত মুঠোফোন চালানোর রুটিনে। কিন্তু এই খুশি বেশি দিন টিকল না। গত বছরের ২৭ জুলাই সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে দুই ছিনতাইকারী পেটে আর পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে নিয়ে গেল আমার এক মাসের কম ব্যবহার করা নতুন মুঠোফোন। সেদিন থেকেই আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের শুরু।
বদলে যাওয়া দিনগুলো
দীর্ঘদিনের অভ্যাস তো এক দিনে বদলানো যায় না। ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টে ফেলতে শুরু করলাম। ভোর পাঁচটার বদলে রাত বারোটায় ঘুমানো শুরু করলাম, স্কুলজীবনের মতো গল্প-উপন্যাসের বই আবার পড়া শুরু করলাম, সকাল-সন্ধ্যায় ব্যায়াম আর জগিং করা অভ্যাসে পরিণত করলাম। প্রথম এক-দেড় মাস খুবই কষ্ট হয়েছিল মানিয়ে নিতে। কারণ, আমার চারদিকের পরিবেশটাই পাল্টে গিয়েছিল। হয়তো একই পরিবেশ ছিল কিন্তু আমার কাছে নতুন লাগছিল। মুঠোফোনে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে আশপাশে কী আছে, কখনো তেমন খেয়ালই করা হয়নি।
১০০ দিন পর আমার চেহারাই পাল্টে গেল। আয়নায় একজন হাড্ডিসার তরুণের বদলে একজন স্বাস্থ্যবান, সবল যুবককে দেখা গেল। মূলত এর পরেই আমি কিশোর আলো ম্যাগাজিনে আমার মুঠোফোন ছাড়া জীবন যাপন করা নিয়ে একটি লেখা লিখি। আমি চাইছিলাম না আর মুঠোফোন ছাড়া থাকতে। কিন্তু সেই লেখার শেষে আমি লিখেছিলাম, ১০০ দিন আমার লক্ষ্য না। ১০০ দিনকে ৩৬৫ দিনে নিয়ে যেতে চাই। এই লাইনটি লিখে বলা যায় ফেঁসেই গিয়েছিলাম। কারণ সেই লেখাটি এত প্রতিক্রিয়া পায় যে আমার ৩৬৫ দিন পূরণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না!
আপনারা হয়তো ভাবছেন, এরপর থেকে আমার বাজে দিন শুরু হয়েছিল। কিন্তু না! আমি ধ্যান (মেডিটেশন) শুরু করলাম। শিগগিরই ফোকাস নির্দিষ্ট হলো। বই পড়া আরও বাড়িয়ে দিলাম। আসলেই সামাজিক হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে যে বন্ধুদের আগে শুধু ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রামে কথা হতো, তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কিংবা পলাশীতে দেখা হতে লাগল। পরিচিত মানুষদের ‘হাই’, ‘বাই’ বলার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথোপকথন শুরু হলো। তবে মুঠোফোন না থাকলে একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করা আর তাকে খুঁজে পাওয়াটা যে কত কষ্টকর, আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম। পরে আমার এক বান্ধবী একটা উপায় বের করে দিয়েছিল যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে আসতে হবে। অপরজনের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ আধঘণ্টা অপেক্ষা করা যাবে। আধঘণ্টার মধ্যে না এলে বুঝে নিতে হবে অন্যজন কোনো কারণে আসতে পারছে না। এই উপায় বেশ কার্যকরী হলেও বেশ কয়েকবার বন্ধুবান্ধবের কাছে বকাও খেতে হয়েছিল। কারণ, তারা যানজটে পড়ায় আসতে দেরি করেছিল আর আমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম।
আমি পড়ি দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশে (আইসিএমএবি)। একটা সময় ভাবতাম পড়ালেখা ছাড়া আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। কিন্তু মুঠোফোন না থাকার কারণে এবং বাসার কম্পিউটারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কম ব্যবহারের ফলে আমার বিরাট অবসর তৈরি হয়েছিল। ভেবে দেখলাম আমি পড়াশোনার বাইরেও অনেক কিছু করতে পারি। আমি বড় হওয়ার পর সব সময় পেশা হিসেবে অভিনয়কে চেয়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না।
অবসর সময়ে অভিনয় অনুশীলন করতে করতে বড় হয়ে চাকরিজীবী হওয়ার ইচ্ছা একেবারেই উবে গেছে। আপনারা শুনলে হাসতে পারেন, কিন্তু আমার এখন স্বপ্ন একজন হলিউড অভিনেতা হওয়া! নায়ক নয়, অভিনেতা হওয়া। নায়ক তো সবাই হতে পারে। অভিনেতা আর কজনই বা হতে পারে বলুন! এ ছাড়া আমি সব সময়ই রম্য–কৌতুক নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। তাই ঠিক করেছি অভিনয়ের পাশাপাশি ইউটিউবে ভিডিও বানাব। সে জন্য আমার প্রায় ৩০০ ভিডিওর আইডিয়াও তৈরি। এখন শুধু বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়ার বাকি।
সেদিন যদি আমার মুঠোফোন ছিনতাই না হয়ে যেত, তাহলে হয়তো আমার কখনোই জানা হতো না পৃথিবীটা কত সুন্দর। আমি হয়তো কখনোই ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখতাম না। কাগজের ম্যাপ হাতে নিয়ে অপরিচিত জায়গায় ঘুরতে যেতাম না। কিংবা মাঝনদীতে নৌকা থেকে ঝাঁপ দেওয়াও হয়তো হতো না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমি হয়তো জানতেই পারতাম না আমি কে!
এখন আমি নিজেকে চিনি এবং জীবনকে উপভোগ করতে পারি। হয়তো কোনো দিন আবার মুঠোফোন ব্যবহার করতে হবে। তবে আমি আমার একটি লক্ষ্য পূরণ করে ফেলেছি এবং আরও লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি। কেউ যদি মুঠোফোন ছাড়া জীবন যাপন করতে চান এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন মুঠোফোন ছাড়া বেঁচে থাকা কি সম্ভব? বলব, কেন নয়? মুঠোফোন তো আর খাদ্য, পানি কিংবা অক্সিজেন না!