বারান্দায় রাতুলকে নিয়ে খেলছিলেন জামিল সাহেব। এক বছর বয়সী নাতিকে একবার ওপর দিকে তুলে ধরেন, আবার সাঁই নামিয়ে আনেন বুকের কাছে। ওপর দিকে তুলে ধরলে চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ভয় ও বিস্ময়, আবার নামিয়ে আনলে আনন্দে খলখল করে হেসে ওঠে শিশুটি। দাদা-নাতির উচ্ছ্বসিত মুহূর্তগুলোর দিকে নিজের ভেতর তাকিয়ে একটা অদ্ভুত সুখ ও তৃপ্তির অনুভূতি টের পান আনিকা। তাঁর ছেলেটা যেন এই পরিবারের পুনর্মিলনের উত্সব হয়ে এসেছে। এখন কি জামিল সাহেবের, মানে আনিকার বাবার একবারও মনে পড়বে তিনি জীবনে কোনো দিন মেয়ের মুখ আর দেখবেন না বলেছিলেন! সেই দিনগুলোর কথা মনে করতে চান না আনিকা। দুর্বিষহ দিনগুলো ভেবে এখনই আরও একবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
হাসনাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। দুজনই শিক্ষার্থী ছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। হাসনাত দুই বছরের বড়। পাস করে বেরিয়ে একটা ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আনিকার শেষ বর্ষ। পরিবারে তখন পাত্রের সন্ধান চলছে। একজন চিকিত্সক পাত্রের পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা মোটামুটি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর উপায় নেই। বাধ্য হয়েই মা-বাবাকে নিজের পছন্দের কথাটা জানিয়ে দিয়েছিলেন আনিকা। প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন জামিল সাহেব। মা রিজিয়া বেগমও মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বুঝিয়েছিলেন মেয়েকে। কিন্তু আনিকা তো তখন হাসনাতকে ছাড়া আর কারও কথা ভাবতেই পারছেন না। এদিকে জামিল সাহেবেরও এক কথা, মা-বাবার কথা না শুনলে সেই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কোনো দরকার নেই। অবাধ্য মেয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না তিনি।
তারপর যা ঘটার ঘটেছিল সিনেমার মতো। কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে, এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়া ইত্যাদি। রাতুল হওয়ার সময় প্রায় মরতে বসেছিলেন আনিকা। দুর্ভাগ্যের মতো সৌভাগ্যও বোধ হয় একা আসে না। কঠিন অস্ত্রোপচারের পর মা-ছেলে বেঁচে গেল। প্রচণ্ড উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার পর মেয়েকে ফিরে পেয়ে জামিল সাহেবও গ্রহণ করলেন মেয়ে ও জামাইকে। আর এখন তো নাতিকে নিয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর। নাতিকে কোলে নিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করেন—‘পাসিং গ্রেট টাইম উইথ মাই নিউ লিটল ফ্রেন্ড।’
ঘটনাটি সাদামাটা, জরিপ বা গবেষণা ছাড়াও বলা যায়, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রকমই ঘটে। মা-বাবার অমতে বিয়ে করা মেয়ে বা ছেলের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটে পরিবারে নতুন অতিথির আগমনের সূত্রে। এ গল্পে চমক নেই, নাটকীয়তাও নেই, কিন্তু স্বস্তিকর।
তবে সব সময় এ রকমই ঘটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। থাকলে আরেক আনিকাকে আত্মহত্যা করতে হতো না। এসএসসি পড়ার সময় সিনেমার খলনায়ক ধরনের হাসনাতকে ভালো লেগেছিল তার। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায় গা ঘেঁষে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে, লাল একটা স্কার্ফ ছুড়ে দিয়ে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে চলে গিয়েছিল বাতাসের বেগে। অন্য সহপাঠিনীদের সামনে নিজেকে নায়িকা মনে হয়েছিল সেদিন। বাসায় ফিরে ছাদে একা একা লাল স্কার্ফটা হাওয়ায় উড়িয়ে নিজেও যেন ভেসে বেড়িয়েছিল কল্পনার রাজ্যে। মাথায় উঠেছিল পড়াশোনা। কয়েক দিন এখানে–ওখানে দেখা হলো। শেষে সোজা বাবার সামনে গিয়ে হাসনাতকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল আনিকা। এইটুকুন মেয়ের এই ঔদ্ধত্যে বিস্মিত জামিল সাহেব। পায়ের চপ্পল খুলে লাগিয়ে দিয়েছিলেন কয়েক ঘা। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, নেহাত বখাটে মাস্তান এই ছেলে। পারিবারিক অবস্থাও ভালো না। কিন্তু মেয়ে তখন গল্প-সিনেমার রূপকথায় বিভোর। পালিয়ে গেল একদিন।
এসব ক্ষেত্রে যা হয়, সম্রাট শাহজাহানের প্রেমও অটুট থাকল না, তাজমহল ভেঙে পড়তেও সময় লাগল না। কিছুদিন সংসার করার পর আসল খলনায়ক বেরিয়ে এল স্বরূপে। মাদকাসক্ত হাসনাত নানাভাবে নির্যাতন করত আনিকাকে। এখন কোন মুখে মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে আনিকা? প্রায় অনিবার্য পরিণতির মতো একদিন আনিকার আত্মহত্যার সংবাদ বেরোল পত্রপত্রিকায়। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে খুন করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
এই দুটো ঘটনা থেকে মা-বাবার অমতে বিয়ে নিয়ে কিছু বিষয় চলে আসে আমাদের সামনে। যেমন মা-বাবা হয়তো ছেলে বা মেয়েকে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে বা মেয়ে ইতিমধ্যেই পছন্দ করেছেন অন্য একজনকে। ব্যাপারটা কিছুতেই মা-বাবা মেনে নিতে চান না। এটা হচ্ছে একধরনের ‘ইগো’ বা ‘অহং’। নিজে গিয়ে যেমন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সন্তানকে, বিয়ের ক্ষেত্রেও নিজে সে রকম একটা ভূমিকা পালন করতে চান তাঁরা। কিন্তু এটা ভুলে যান, সন্তান এখন বড় হয়েছে, মানুষ চেনার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে। তার জীবনসঙ্গী পছন্দের অধিকারও তার রয়েছে। সুতরাং তাকে পরামর্শ দিতে পারি, নিজের মতো চাপিয়ে দিতে পারি না। তার পছন্দকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। মতের মিল হলো না বলে সংসারের রণক্ষেত্রে সন্তানকে একা না পাঠিয়ে, তাদের পাশে থাকাটাই ভালো অভিভাবকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে অপরিণামদর্শী এক কিশোরীর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। জীবন যে নাটক-সিনেমা নয়, এটা বোঝার বয়স তার হয়নি। ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের এবং ২১ বছরের নিচে ছেলের বিয়ে করা যে আইনে অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তার পেছনে কিন্তু শারীরিক কারণের পাশাপাশি এই মানসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতার কথাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের উচিত সাময়িক ভালোলাগা বা ভালোবাসাকে বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়ার আগে নিজের বয়স বিবেচনা করা। জীবন অনেক বড়। সাময়িক মোহ কেটে যেতে বেশি দিন সময় লাগে না। কিন্তু একবার ভুল হয়ে গেলে তার খেসারত দিতে হয় সারা জীবন। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য মা-বাবারও দায়িত্ব আছে। শুধু ছেলেমেয়ের ঔদ্ধত্য বা দুঃসাহস ভেবে তাদের পছন্দের কথাটাকে উড়িয়ে না দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া ও বোঝানো, যাকে বলা যথার্থ ‘কাউন্সেলিং’, সেটা করতে হবে। সেটা নিজে ঠিকভাবে করতে না পারলে পরিবারের সুবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ একজনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। মোটকথা, তাকে অপমান ও ধিক্কারের দিকে ঠেলে না দিয়ে পরিবারের আনন্দময় আবহের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে হয়তো সাময়িক মোহ থেকে ফিরে আসা সম্ভব হবে তার পক্ষে।
মা-বাবার মতামতই সব সময় শ্রেষ্ঠ, সেটা যেমন নিশ্চিত করে বলা যায় না, তেমনি মা-বাবার অমতে বিয়ে করাটাই সবচেয়ে ভালো পথ, এমনটাও গ্যারান্টি দিয়ে বলার উপায় নেই। মধ্যপন্থাটাই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো। যেমন কাউকে ভালো লাগলে, সব দিক থেকে উপযুক্ত মনে হলে, তার সঙ্গে সারা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, সেটা মা-বাবাকে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবারও উচিত সন্তানের বিবেচনাকে সম্মান জানানো। কারণ, সে এখন চিন্তা-বুদ্ধিতে পরিণত হয়েছে।
আবার এমনও হতে পারে, বিয়ে-শাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিজে নিতে পারল না। সে ক্ষেত্রে মা-বাবার পছন্দের পাত্র বা পাত্রীটা কেমন, সেটা যাচাই করে, তার সঙ্গেও সংসারের পথ পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সে রকম সুখী পরিবারেরও অভাব নেই আমাদের সমাজে। মোটকথা, অমতের বেড়াটা ডিঙিয়ে সমঝোতার পথে আসার দায়িত্ব দুপক্ষেরই।
শুরুতে জামিল সাহেব আর রাতুলের যে আনন্দময় মুহূর্তের দৃশ্যটি বর্ণনা করেছিলাম, সেই দৃশ্যটিই সবচেয়ে কাম্য। তাতে প্রৌঢ় জামিল সাহেবদের জীবনটা যেমন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তেমনি রাতুলদের শৈশবও হয়ে ওঠে স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠার একটি আনন্দময় ভুবন।
লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক