মা না থাকলে সেদিন হয়তো ফুটবল ছেড়েই দিতাম: ডি মারিয়া

ডি মারিয়ার গোলে কদিন আগে কোপা আমেরিকার ফাইনাল জিতে নিল আর্জেন্টিনা। অথচ ছেলেবেলায় একাধিকবার ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন এই আর্জেন্টাইন ফুটবলার। কীভাবে মা আর সতীর্থরা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, সে কথাই তিনি লিখেছেন প্লেয়ার্সট্রিবিউন ডট কমে।

ডি মারিয়া
 ছবি: রয়টার্স

তখন চার বছর বয়স। আমাকে নিয়ে মা গেলেন ডাক্তারের কাছে। বললেন, ‘ছেলেটাকে নিয়ে কী করি বলুন তো? সারাক্ষণ দৌড়ায়। ছোটাছুটি কিছুতেই থামে না।’

ডাক্তার যেহেতু আর্জেন্টিনার বাসিন্দা, তাঁর উত্তরটা অনুমেয়ই ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘কী করবেন মানে! ছেলেকে ফুটবল খেলতে দিন।’

এভাবেই শুরু।

মনে আছে, আমি এতটাই পাগলের মতো ফুটবল খেলতাম, দুই মাস পরপর আক্ষরিক অর্থেই আমার জুতা দুই ভাগ হয়ে যেত। মা তখন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিতেন। কারণ, কদিন পরপর নতুন জুতা কেনার মতো টাকা আমাদের ছিল না। নিশ্চয়ই খুব ভালো খেলছিলাম। কারণ, সাত বছর বয়সেই দেখা গেল, আমি আমার এলাকার দলের হয়ে ৬৪টি গোল করে ফেলেছি। একদিন মা ডেকে বললেন, ‘স্থানীয় রেডিও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।’

আমরা রেডিও স্টেশনে গেলাম, সাক্ষাৎকার দিলাম। আমি অবশ্য ভীষণ লাজুক ছিলাম। কথা একরকম বলিনি বললেই চলে।

সে বছরই বাবা রোজারিও সেন্ট্রাল দলের তরুণ কোচের কাছ থেকে কল পেলেন। ওরা চাচ্ছিল, আমি যেন ওদের হয়ে খেলি।

আর এভাবেই জন্ম হলো গ্রেসিয়েলার।

গ্রেসিয়েলা—একটা মরিচা ধরা, পুরোনো, হলুদ বাইসাইকেল। মা প্রতিদিন এই সাইকেলে করে আমাকে প্র্যাকটিসে নিয়ে যেতেন। সাইকেলের সামনে একটা ছোট ঝুড়ি ছিল। চালকের পেছনে ছিল একজন বসার মতো জায়গা। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিদিন আমার ছোট বোনকেও সঙ্গে নিতে হতো। তাই বাবা সাইকেলের এক পাশে কাঠ দিয়ে একটা সিট বানিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে আমার বোন বসত।

ভাবুন তো! এক নারী সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। পেছনে তাঁর ছেলে, এক পাশে বসা মেয়ে, আর সামনের ঝুড়িতে ছেলের বুটজুতা, কিছু খাবার। সাইকেল কখনো পাহাড় বেয়ে উঠছে, কখনো নামছে। বৃষ্টি, শীত, ঘুটঘুটে অন্ধকার... কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আমার মা শুধু প্যাডেল ঘুরিয়ে গেছেন।

একদিন ডি–বক্সে বল হেড করার জন্য আমি লাফ দিইনি। দিন শেষে কোচ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সবার সামনে বললেন, ‘তুমি একটা অকর্মা, নির্লজ্জ। তোমাকে দিয়ে কোনো দিন কিছু হবে না।’

গ্রেসিয়েলাই আমাকে পৌঁছে দিল সেখানে, যেখানে আমি যেতে চেয়েছি।

কিন্তু সত্যি বলতে, সেন্ট্রালে আমার সময়টা সহজ ছিল না। এমনকি মা না থাকলে আমি হয়তো ফুটবল খেলা ছেড়েই দিতাম। দুবার ছেড়ে দিতে চেয়েছি।

১৫ বছর বয়সেও শারীরিক গড়নে আমি যথেষ্ট বেড়ে উঠছিলাম না। কোচ ছিলেন একটু খ্যাপাটে ধরনের লোক। তিনি সেই সব খেলোয়াড়দের পছন্দ করতেন, যাঁরা স্বাস্থ্যবান এবং খেলার মাঠে আক্রমণাত্মক। এই দুই ‍দিক বিবেচনায় আমি একদমই বেমানান। একদিন ডি–বক্সে বল হেড করার জন্য আমি লাফ দিইনি। দিন শেষে কোচ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সবার সামনে বললেন, ‘তুমি একটা অকর্মা, নির্লজ্জ। তোমাকে দিয়ে কোনো দিন কিছু হবে না।’

ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সব সতীর্থের সামনে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।

বাড়ি ফিরেই সোজা ঢুকে পড়েছিলাম নিজের ঘরে। একা একা কাঁদছিলাম। মা ঠিকই বুঝেছিলেন, একটা কিছু হয়েছে। কারণ, প্রতি রাতে বাড়ি ফিরেই আমি আবার বেরোতাম, রাস্তায় খেলতাম। মা আমার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? আমি তাঁকে সত্যিটা বলতে ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ, জানি, সবটা জানলে তিনি এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে ছুটে যাবেন আমার কোচকে ঘুষি মারার জন্য। এমনিতে মা খুব শান্ত মানুষ। কিন্তু যদি আপনি তাঁর ছেলে–মেয়ের সঙ্গে কিছু করেন...খবর আছে!

মাকে বললাম, আমি একটা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তিনি জানতেন, আমি মিথ্যা বলছি। এসব ক্ষেত্রে অন্য মায়েরা যা করেন, আমার মা-ও তা-ই করলেন। আমার এক সতীর্থকে ফোন করে সত্যিটা জেনে নিলেন।

একটু পর মা যখন আবার এলেন, আমি তখন চিৎকার করে কাঁদছি। মাকে বললাম, আমি আর ফুটবল খেলতে চাই না। পরদিন আমার বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছে করছিল না। স্কুলেও যেতে চাইনি। ভীষণ অপমানিত লাগছিল। কিন্তু তখন মা এলেন। আমার বিছানায় বসে বললেন, ‘তুমি যাবে। আজই যাবে এবং নিজেকে প্রমাণ করবে।’

সেদিন আমি আবার প্রশিক্ষণে গেলাম আর খুব অবাক করা একটা ব্যাপার ঘটল। বন্ধুরা কেউ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করল না। উল্টো সাহায্য করল। বল যখন বাতাসে ভেসে ছুটে এল, ডিফেন্ডাররা আমাকেই হেড করার সুযোগ করে দিল। আমার যেন একটা ভালো দিন কাটে, সেটা তারা নিশ্চিত করেছিল। সারা দিন আমাকে দেখে রেখেছে।

ফুটবল একটা ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক খেলা। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকায়। সবাই ফুটবল খেলে একটা সুন্দর জীবন পেতে চায়। কিন্তু সেই দিনটা আমি আজীবন মনে রাখব। কারণ, আমার সতীর্থরা সেদিন বুঝতে পেরেছিল, আমি কষ্ট পাচ্ছি। আর ওরাই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত