মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি...

ঈদে আমরা বাড়ি ফিরি মূলত নিজের কাছে প্রত্যাবর্তনের জন্য। মডেল: আরেফিন শামস, শাফিন ও শ্রাবন্তী
ছবি: কবির হোসেন

ঈদে বাড়ি ফেরার কথা মনে হলে আমার কেন যেন ফটিকের কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ‘বালকদিগের সর্দার’ ফটিক চক্রবর্তীর আদলটি কেবলই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সেই ফটিক, বিলাপরত মায়ের কান্নার জবাবে যে বলেছিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’

প্রতিবছর দুই ঈদের ছুটিতে আমিও ফটিকের এই এক টুকরা কথাটি মনে মনে জপি। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক মায়ের কাছে যেতে চাইলে মামা বিশ্বম্ভরবাবু তাকে বলেছিলেন, পূজায় স্কুল ছুটি হলে বাড়ি যাওয়া যাবে। আর ‘ঢাকায় যারা চাকরি গো করে’ এই আমরা, ঈদে আমরা বাড়ি যাই কর্মস্থল বা ‘অফিস’ ছুটি হলে; এবং ছাত্ররা গাড়ির টিকিট কাটে বিদ্যায়তনে ‘ছুটির বাঁশি’ বাজলেই।

আদতে দুই ঈদের ছুটিতে আমরা যারা, যেসব কোটি কোটি ‘ফটিক’ নাড়ির টানে বাড়ি ফেরে, তারা তো মায়ের কাছেই ফেরে। ফেরে বোনের কাছে, ভাইয়ের কাছে, বন্ধুর কাছে। স্বামী ফিরে যান বউয়ের কাছে। বাবা আদরের সন্তানের কাছে। মাটির কাছেও কি নয়?

সংবাদপত্রের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ঈদে কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়েন। এই যেমন গত রোজার ঈদে ঢাকা ছেড়েছিলেন ৭০ লাখ মানুষ। এ তো গেল শুধু ঢাকার হিসাব-নিকাশ। এর বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ অন্যান্য শহর খালি করে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা পাড়ি দিয়ে দুই ঈদে যত মানুষ ঘরে ফেরেন, সংখ্যার বিবেচনায় সেটি বিপুল, কয়েক কোটি হবে নিশ্চয়ই।

ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কিনতে এবারও দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ছে।

হ্যাঁ, বিস্তর ঝক্কি পেরিয়ে এসব আম আদমি (পড়ুন: ফটিকেরা) ‘দেশে’ ফেরেন ঈদের অবকাশে। আর এই ফেরা উপলক্ষে গাবতলী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা অন্য কোনো স্টেশনে তখন তাল তাল মানুষ, একটি টিকিটের জন্য মানুষের মাথা মানুষে খায়। হোক না টিকিটের আকাশচুম্বী বাড়তি দাম, তবু সেই ‘সোনার হরিণ’-এর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, সুদীর্ঘ লাইন, অতঃপর টিকিট মিলল তো শুরু হলো অন্য এক প্রতীক্ষা, কখন আসবে গাড়ি? এরপর গাড়ি এল, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ নিয়ে তার চাকা ঘুরতেও আরম্ভ করল একসময়, কিন্তু ওই গাড়ি আর কত দূর যেতে পারে, পথে পথে যে কাঁটার মতো বিছানো রয়েছে লাগামহীন যানজট, গাড়ি যে আর নড়ে না! এ সময় বাড়ি ফেরা যাত্রীদের ‘দেশে ফেরার খাতা’য় শুধু যানজটের গল্প নয়, লেখা হয় আরও বিস্তর অভিজ্ঞতা, তাতে ‘পথ কখন শেষ হবে?’—এই প্রশ্ন জানার আকুলতা যেমন থাকে, থাকে খিদের কষ্ট, অনেকক্ষণ ঠায় বসে থাকার ক্লান্তি; একই সঙ্গে লেখা থাকে দীর্ঘ অনির্দিষ্ট সময়ের যাত্রাহেতু বাথরুম করতে না পারার যাতনাও। তাই প্রবল বিরক্তিতে কেউ কেউ তখন হয়তো আপনমনে বলেন, ‘এবারই শেষ, এত কষ্ট করে ঈদে আর কখনোই বাড়ি যাওয়া নয়।’

পরে সবকিছু উজিয়ে, ৬ ঘণ্টার যাত্রা ১২ ঘণ্টায় শেষ করে, অবশেষে নগর থেকে যখন ফেরা হলো প্রত্যাশিত সেই নিজস্ব ঘরে, সে সময় কে আর মনে রাখে পথের ওই অবর্ণনীয় কায়ক্লেশ! ঈদের বাঁকা চাঁদ তখন একেকজন ফটিকের মুখে হাসি হয়ে আলো ছড়ায়, হাসি ফোটে বাড়িতে থাকা তাঁর স্বজনের মুখেও। ফলে গতবারের না-ফেরার প্রতিজ্ঞা ভুলে ঈদে-চান্দে মানুষেরা বারবারই নাড়ির টানে বাড়ি ফেরেন, এবারও যেমন ফিরবেন।

কিন্তু এত কষ্ট স্বীকার করে প্রতি ঈদে কেন বাড়ি ফিরি আমরা?

শিকড়ের টান তো থাকেই। এ ছাড়া আছে আরেকটি কারণ, নিজের কাছে ফেরা। ঈদে আমরা বাড়ি ফিরি মূলত নিজের কাছে প্রত্যাবর্তনের জন্য। নিজের ‘স্বাধীনতা’র জন্য। কেননা, যতক্ষণ আমরা নগরের কর্মব্যস্ত নাগরিক, ততক্ষণ নানা নিয়ম আর অনুশাসনের ছক মেনে চলতে হয় আমাদের। এখানে অনেক ক্ষেত্রে ‘অন্যের নির্দেশিত জীবনে’ পা গলিয়ে আমরা চলি। কেবল এই ছুটির অবসরের দিনগুলোতে আমার জীবনটি যেন আমার মতো, হয়ে ওঠে ‘যেমন ইচ্ছা লেখার আমার কবিতার খাতা।’ ‘নিজের বাড়ি’ কবিতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বেশ ঢোলসহরত করেই তো বলেছেন সেসব:

‘ভাবতে ভালো লেগেছিল, এই ঘর,

ওই শান্ত উঠোন,

এই খেত, ওই মস্ত খামার

সবই আমার

এবং আমি ইচ্ছে হলেই পারি

ইচ্ছেমতন জানলা-দরজা খুলতে

ইচ্ছেমতন সাজিয়ে তুলতে

শান্ত সুখী একান্ত এই বাড়ি।’

এ জন্যই কি প্রতিবার ঈদের ঠিক আগে আগে, অফিসে ছুটির নোটিশ জারি হওয়ামাত্রই আমিও কোনোমতে ঠেলেঠুলে মাথা ঢুকিয়ে দিই ঝিনাইদহগামী কোনো বাসে! মনে পড়ে, বাড়ি যাওয়ার সময় কত কিছু মনে পড়ে! সেই যখন ছাত্র ছিলাম, ছিল হাত টানাটানি; ছিল না ঢের বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কাটার সামর্থ্য। ফলে ঈদের দু-এক দিন আগে ঢাকা শহর পায়ে দলে পৌঁছে যেতাম নবীনগর। সেখান থেকে তুলনামূলক কম ভাড়ার ‘মফিজ-টানা’ গাড়িতে (লোকাল গাড়ি) সম্মানিত ‘মফিজ’ হিসেবে অভিষেক। একে তো কম ভাড়া দেওয়ার ‘অপরাধ’, তার ওপরে আবার সিট! সিটের পরোয়া কে করে? ঈদের সময়ের ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ মোড়া অথবা একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলেই তো আমি বর্তে যাই তখন। খুশিতে যেন ঈদের চাঁদই উঠিয়ে দিতাম মনে মনে এবং গানে গানেও, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’।

নীল রঙের দোচালা এই বাড়িটি এখনো অপেক্ষায় থাকে

পথ অবশ্য শেষ হতো আরিচা ঘাটে এসে। এরপর ঢেউ গুনতে গুনতে লঞ্চ বা ফেরিতে গাদাগাদি করে পদ্মা নদী পেরোনো। শেষে আরেকটি বাসে ঝুলতে ঝুলতে বেশির ভাগ সময় ভোররাতে নিজের শহরে পা রাখা। ঢাকা থেকে ২১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরার পর বুকের মধ্যে কেমন শান্তি শান্তি হাওয়া দোলা দিয়ে যেত যেন। আর সেই শেষ রাতে মফস্বল শহরের এক মাথায় আমাদের নীল রঙের দোচালা বাড়ির দরজায় যখন আমার হাত পড়ত, তখন কাউকে না ডাকলেও কেবল আমার দরজা ঝাঁকানোর শব্দে আম্মা কীভাবে যে বুঝে যেতেন, বাড়ি ফিরেছি আমি! এরপর কী হতো?

‘বহুদিন যে দরজার কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না,

মরচে পড়া সেই দরজা মুহূর্তেই

ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল।’

নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতার এই পরিচিত দুই চরণ সে সময় প্রবলভাবে সত্য হয়ে উঠত আমার জীবনে। আমি বাড়ি ফিরতাম।

ঈদের চাঁদ মাথায় করে বাড়ি আমি এখনো ফিরি। আমার এখনকার যাত্রায় বাহনরূপে সেই মফিজ-টানা গাড়ি নেই, ভেঙে ভেঙে যাওয়া নেই বটে। কিন্তু এখন ঈদের ক্ষণে পরিবারসমেত বাড়ি ফেরার সময় ফেরিঘাট ও অন্যান্য জটজটিলতায় পাঁচ ঘণ্টার ঘরযাত্রা যখন ১৫ ঘণ্টায়ও শেষ হয় না, সে সময় কখনো কখনো কিঞ্চিৎ ‘মফিজ’ হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কীই–বা করার থাকে!

আমার মতো এই বাস্তবতা আজকাল অনেকেরই। তারপরও যে বাড়িকে আমরা ‘দেশ’ বলি, ঈদ উপলক্ষে সেই দেশে যাওয়ার সময় আমাদের কারও কারও কেন যে শুধু ফটিকের কথা মনে হয়... ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’