রসুইঘরের উদ্যোক্তা

মায়ের নামে মেয়ের উদ্যোগ

৮০ টাকা। অঙ্কের হিসাবে নেহাতই সামান্য অর্থ। কিন্তু অঙ্ক দিয়ে এ আনন্দ পরিমাপ করা যাবে না। তরুণ উদ্যোক্তার প্রথম উপার্জন বলে কথা। টাকাটা যখন হাতে পেয়েছিলেন, মনে হয়েছিল, সফলতার প্রথম সিঁড়িটায় পা রাখলেন মাত্র। টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিলেন। মা তাকালেন মেয়ের দিকে। মুহূর্তেই মা-মেয়ের চোখে চোখে বলা হয়ে গেল যেন কতশত কথা।

ঘরে তৈরি খাবার সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করছেন নিশাত তাসনিম
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম দিনের সেই মুহূর্তের কথা মনে করতে পারেন নিশাত তাসনিম। এরপর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। ৮০ টাকার ছোট্ট সেই অঙ্ক বেড়ে এখন কততে পৌঁছেছে? সরাসরি নয়, নিশাত তাসনিমের জবাব কিছুটা কৌশলী। জানালেন, বাসাভাড়া, বাজারসদাই, নিজের পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলে যাচ্ছে তাঁর স্বনির্ভর জীবন।

২০১৬ সালে বাবাকে হারান নিশাত তাসনিম। তিনি তখন মাত্রই স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ভয়াবহ ঝড়ের মতোই মা-মেয়েকে এলোমেলো করে দেয় বাবার মৃত্যু। একসঙ্গে অনেক করাল বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ায়। মাকে সামলানো, সংসার খরচ, নিজের পড়াশোনা—সে এক দিশেহারা অবস্থা। বাবার জন্য যে একটু শোক করবেন, সেই অবকাশটুকুও ছিল না। বরং নিজেই মা হয়ে সন্তানের মতো মাকে আগলেছেন।

সংসারের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা। নিশাত তাসনিম নিজেও টিউশন, কোচিং করে মাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের পড়াশোনা? এ সময়েই মামা আর খালারা এসে দাঁড়ালেন পাশে। নিশাতের পড়াশোনার খরচ চালানোর দায়িত্ব নিলেন তাঁরা। মা তত দিনে একটা বুটিক শপে কাজ নিয়েছেন।

একসময় নিশাতের মনে হলো এভাবে কত দিন? আরও ভালোভাবে নিজেই কিছু শুরু করা যায় না! স্বনির্ভরতার এ ভাবনাই তাঁকে উদ্যোগী করে। ২০১৭ সালে ইউটিউবে একটি চ্যানেল খুলে বসলেন। পোশাকের রিভিউ দিয়ে সাড়াও পাচ্ছিলেন বেশ। কিন্তু হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটাও থেমে যায়।

এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর ফেসবুকে রান্নাবান্নার একটা পাতা খুললেন নিশাত তাসনিম। নাম ‘পাপড়ি’স ড্রিম’। কেন এই নাম? পাপড়ি কে? নিশাত জানালেন, স্বনির্ভরতা যেমন একটা স্বপ্ন, আবার যুদ্ধও। আর এই স্বপ্ন ও যুদ্ধ তো তাঁর একার নয়, বরং মা-মেয়ের যৌথ যুদ্ধ। বাবার মৃত্যুর পর মাকেও লড়তে হয়েছে। তবে কি নিশাতের মায়ের নাম পাপড়ি? ঠিক তা–ই। মায়ের নামেই উদ্যোগের নামকরণ করেছেন ‘পাপড়ি’স ড্রিম’। ঢাকার মোহাম্মদপুরে তাঁর রসুইঘর।

শুরুতে রান্নাবান্না মা-ই করতেন। এখন নিশাতও শিখে নিয়েছেন অনেক কিছু। মায়ের কোন রান্না বেশি জনপ্রিয়? জানালেন, হাঁসের মাংস, মুরগির রোস্ট দারুণ জনপ্রিয়। তবে এখন মায়ের হাতের খুদের ভাত, ভর্তা রীতিমতো সিগনেচার ডিশ হয়ে গেছে। নিশাত তাসনিম নিজে কোন রান্নাটি ভালো পারেন? জানান, চায়নিজটা তিনি ভালোই রাঁধেন। গ্রাহকও বেশ পছন্দ করে। চায়নিজের অর্ডার এলে সাধারণত তিনিই রাঁধেন। কিন্তু সব ধরনের বাঙালি খাবারই তাঁরা সরবরাহ করেন। আর বাঙালি রান্না মানেই মায়ের ওপর নির্ভরতা। মায়ের হাতের রান্নার প্রতি বাঙালির সেই যে চিরায়ত মুগ্ধতা, তার ছাপ যেন পাওয়া যায় এই কথায়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক করছেন নিশাত তাসনিম। চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা দিয়েছেন। এখন ফলাফলের অপেক্ষায়। তবে স্বনির্ভর জীবনের যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এ পর্যায়ে এসে মনে হয়, ঠিক পথেই আছেন। সাফল্য আসছে, বাড়ছে সাহস।