মায়েরা তো মা-ই

>এ বছর মা দিবসের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে ছেলেদের নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকাদের মায়েরা। ছেলেরা সবাই এখন বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডে। মায়েরা জানাচ্ছেন সেই বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা। আর সঙ্গে রইল মায়েদের শুভকামনা। এই মায়েদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা লিখেছেন সেই বিজ্ঞাপনের নির্মাতা।
বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন মাশরাফির মা হামিদা মুর্তজা
বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন মাশরাফির মা হামিদা মুর্তজা

যে যত বড়, যত সফল সন্তানের মা–ই হোন না কেন, সন্তানকে নিয়ে কথা বলার সময় মায়েদের চোখের কোণে আবেগ ধরা দেয়। সেটাই অনুভব করলাম এই শুটিংয়ে। আমি আসলে তেমন একটা তফাত পাইনি। আমার কাছে লেগেছে সব মা আসলে একই রকম।

দেখেছি, মাশরাফি বিন মুর্তজার মা–ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে কথা বলার সময় কেমন মায়াময় হয়েছেন; তেমনই আবার সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ, মোসাদ্দেক হোসেন, রুবেল হোসেনের মায়ের চোখে পানি এসেছে ছেলেদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। তেমনই যে মা কথা বলতে পারেন না (মুশফিক রহিমের মা), ছেলের সম্পর্কে তাঁর ভাষাহীন ভাষাও ছিল প্রচুর আবেগময় ও অর্থবহ। দিনটা ছিল শনিবার, বেশ রাতের দিকে ইশতিয়াক শাহরিয়ার ভাইয়ের কল পাই। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর আগামী এক সপ্তাহের ব্যস্ততা কেমন?’ আমি বললাম, ‘অনেক ব্যস্ততা, প্রচুর কাজের চাপ।’ তার পরের ফোন ইশতিয়াক ভাইয়ের বন্ধু রাশেদ ভাইয়ের। তিনি বললেন, ‘এই মধ্যরাতেই আপনার সঙ্গে একটু বসতে চাই। মা দিবসের একটা কাজ, হাতে সময় নেই।’ কিছু না ভেবেই রাশেদ ভাইয়ের অফিসে চলে গেলাম আমি আর ইমরান।

ভাবনাটা শুনেই আমি আটকে গেলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। যত কাজই থাকুক না কেন, এই কাজ করতেই হবে। একটু করে বলতে চাই, এই ভাবনা এসেছে মূলত আল রাশেদ প্রধানের (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্রুপডট) মাথা থেকে। উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের ক্রিকেটারদের তো সবাই চিনি, ভালোবাসি, কিন্তু তাঁদের যাঁরা মানুষ করেছেন, দিন দিন বড় করে তুলেছেন, তাঁদের মুখ থেকেই এবার শুনব ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার গল্প। এবারের মা দিবসে ওই মায়েদের জানাব শ্রদ্ধা ও সালাম। আর এর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে লাইফবয়।

সেই রাতের মিটিং শেষ হলো পরদিন সকাল নাশতা খাওয়ার মাধ্যমে। রাতভর মিটিং করে সকাল থেকেই কাজে নেমে গেলাম। জরুরি মিটিং ডাকা হলো। সকাল সকাল আমাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বিগ ফিশের সব সদস্য হাজির। এরপর একের পর এক মিটিং চলতে লাগল। লাইফবয়ের দল, গ্রুপডট ও আমরা নানা ধরনের মিটিং করে বিজ্ঞাপনের ধরন, মিউজিক, কালারসহ নানা কিছু সেট করলাম, কিন্তু কোনোভাবেই শুটিং ডেট ঠিক করতে পারলাম না। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রমজান মাস শুরু হয়ে যাচ্ছে এবং মোটামুটি সবার মা ঢাকার বাইরে থাকেন।

শুটিংয়ের দিন নির্ভর করবে মায়েদের ওপর। নানা ধরনের প্রচেষ্টায় মায়েদের সময় পাওয়া গেল। এই সময় আমি বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই এখন শুরু হতে যাচ্ছে। সবাই আমাদের তারিখ দিলেন ৭ মে। শুধু সাকিব আর মুশফিকের মা ডেট দিলেন ৮ মে। রুবেলের মা ছাড়া বাকি সবাই থাকেন ঢাকার বাইরে। তার মানে, যেতে হবে সবার গ্রামের বাড়িতে। নড়াইল, সাতক্ষীরা, মাগুরা, ময়মনসিংহ, বগুড়া—এক দিনেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের শুটিং করতে হবে এবং তা প্রচলিত ধারার থেকে আলাদা। আমরা যখন এসব পরিকল্পনা করছি, তখন ৫ মে। হাতে সময় মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

আবারও বিগ ফিশে জরুরি মিটিং। কয়েক ঘণ্টার নোটিশে ছয়টি দল তৈরি করে ফেললেন আমাদের প্রযোজক সেতু মাহমুদ। ৬ মে রাতে একযোগে ছুটে চললাম দেশের বিভিন্ন জেলার সেই সব রত্নগর্ভা মায়ের কাছে। তাঁদের কাছ থেকেই শুনতে যাচ্ছি সোনার সন্তানদের বেড়ে ওঠা আর আনন্দ–বেদনার গল্প। এ এক অন্য অনুভূতির যাত্রা।

মাশরাফি বিন মুর্তজা

বহু পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন কথা বলা শুরু করলাম মায়েদের সঙ্গে, তখন মনে হলো আমরা আসলে নিজের মায়ের সঙ্গেই কথা বলছি। মনে হলো, আমার মা–ও এভাবেই কথা বলেন। সবার গল্পগুলো মোটামুটি একই রকম। শুটিংয়ের সময় সব মায়ের চোখেই পানি এসেছে। শুধু মুশফিক ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় শুটিং ইউনিটের সবার চোখে পানি এসেছে। তিনি ঠিকভাবে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তাঁর সন্তানের জন্য যে এত না–বলা কথা থাকতে পারে, তা আমরা আগে বুঝিনি। তাঁর কথা আমরা শাব্দিকভাবে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু অনুভূতি বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয়নি কারও।

এতগুলো জেলায় এত অল্প সময়ে গিয়ে ঠিকমতো কাজটা করে আনা বেশ কঠিন। অক্লান্ত পরিশ্রমে ঠিক দুই দিনেই শুটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরে এল দলগুলো। তখন মা দিবসের বাকি মাত্র তিন দিন। এতগুলো ক্যামেরার ফুটেজ থেকে বানাতে হবে ৩ মিনিটের চিত্র। করতে হবে সিজি (কম্পিউটার গ্রাফিকস), সংগীত, রং ও শব্দের কাজ।

শুটিং শেষ করে ঢুকতে হলো সম্পাদনার টেবিলে। এডিটর সজল অলোক কিছু কাজ করে রেখেছেন এরই মধ্যে। বানানো হলো ১৫০ মিনিট থেকে ৩ মিনিট ২৬ সেকেন্ড। এদিকে সময় বাকি ১ দিন। সুর–সংগীতের জন্য পাঠানো হলো চিরকুট ব্যান্ডের নীরব ভাইয়ের কাছে। আর সিজি প্যানেলে কাওসার ভাই আর রাতুলের কাছে। আর শব্দের কাজ করবেন শাকুরুজ্জামান।

একসঙ্গে সমান্তরালভাবে চলছে সব। ততক্ষণে প্যানেল ভরে গেছে মানুষে। এজেন্সি গ্রুপডটের আল রাশেদ প্রধান, ইউনিলিভার থেকে ক্লায়েন্ট—সবাই মোটামুটি হাজির। বোঝাই যাচ্ছে, অবস্থাও যাচ্ছেতাই।

কারণ, এটা প্রথমে দেখবেন টাইগাররা এবং তাঁদের সবাই তখন আয়ারল্যান্ডে খেলা নিয়ে ব্যস্ত। এ এক অন্য অনুভূতি। তাঁরা দেখলেন এবং তাঁদের বেশ পছন্দ হলো। তারপর আর কোনো বাধা ছিল না।

অনেক কষ্ট করে দিন–রাত খেটে ১২ মে মা দিবসে ইন্টারনেটে মুক্তি পেল বিজ্ঞাপনচিত্রটি। এক লাইনে কথাটা বললেও এই বিজ্ঞাপনের পেছনে দিন–রাত খেটে কাজ করেছেন কমপক্ষে ১০০ জন। তাঁদের মধ্যে চিত্রগ্রাহক আরিফ ভাই, সুমন, বুলবুল, শফিকুল ইসলাম। টিম ডিরেক্টর ইমরান, মাজেল, মন্টি, হৃদয়। আর পুরো কাজ চলেছে প্রযোজক সেতু মাহমুদের (বিগ ফিশ এন্টারটেইনমেন্ট) পর্যবেক্ষণে।

জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফির মায়ের সঙ্গে নির্মাতা রুবায়েত মাহমুদ

কাজ তো অনেকই হয়, কিন্তু মায়েদের নিয়ে কাজ করতে যে আলাদা এক অনুভূতি হয়েছে, তা টের পেয়েছেন সবাই। কাজটি সবাই সত্যিই মায়ের প্রতি আবেগ–ভালোবাসা থেকে করেছেন। আর এই মা দিবসে বিজ্ঞাপনটি মুক্তির পর সবার আবেগ আরও কয়েক শ গুণ বেড়ে গিয়েছে। আনন্দও লেগেছে অনেক, যখন আমরা দেখলাম লাখ লাখ মানুষ ভিডিওটি দেখছে, শেয়ার দিচ্ছে, মাকে উৎসর্গ করছে। মনে হলো আমাদের এত কষ্ট সার্থক হয়েছে। যখন দেখলাম, আমাদের ক্রিকেটাররা তাঁদের নিজেদের প্রোফাইল থেকে আপলোড ও শেয়ার করেছেন, তখন ভালো লাগাটা আরও বেড়ে গেল। আর সবকিছুর পর আমাদের এই কাজ করা অর্থবহ মনে হলো, যখন দেখলাম আমার মা এই প্রথম আমার কোনো কাজ শেয়ার দিলেন এবং আমাকে অভিনন্দন জানালেন। সব মায়ের ভালোবাসায় গর্জে উঠুক টাইগাররা। সব মায়ের দোয়ায় এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ হোক আমাদের বিশ্বকাপ। এই কামনাই করছি আর বলছি, খেলবে টাইগার, জিতবে টাইগার।

লেখক: নাট্যপরিচালক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা