চিকিৎসক সাকিয়া হক বলছিলেন, দেশের বিভিন্ন জেলার কিশোরীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বদ্ধমূল ধারণা, মাসিকের রক্ত দূষিত। মাসিকের পেছনে শয়তানের হাত আছে। এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই তারা বড় হচ্ছে। মাসিক নিয়ে বাবা, শিক্ষক, এমনকি অনেকে মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারে না। লজ্জা ও ভয় কাজ করে।
দেশের ৬৪ জেলার ৬৪ বা তারও বেশি স্কুলের (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনারারি মেডিকেল অফিসার সাকিয়া হক।
সম্প্রতি চিকিৎসক সাকিয়া হক ও মানসী সাহা স্কুটি হাঁকিয়ে দেশর ৬৪ জেলা ভ্রমণ করে আলোচনায় এসেছেন। গত বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে সাকিয়া হক জানান, ৬৪ জেলায় ভ্রমণে গ্রাম, হাওর, শহরসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুলে তাঁরা বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপের আরেকটি বিষয়বস্তু ছিল বয়ঃসন্ধিকাল ও মাসিক।
সাকিয়া বলেন, কিছু কিছু জেলার মেয়েরা মাসিক সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখে। তবে অনেক জেলার কিশোরীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি প্রকট মাত্রায় রয়েছে। তারা ভ্রান্ত ধারণা মনে পুষে রেখে বড় হচ্ছে। এতে তাদের শারীরিক বিভিন্ন অসুখ ও মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে। বেশির ভাগ জেলার কিশোরীরাই জানিয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে বয়ঃসন্ধিকাল, মাসিকের মতো বিষয়গুলো থাকলেও শিক্ষকেরা তা পড়ান না, বাড়িতে পড়তে বলেন। বাড়িতেও বাবা-মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।
ভ্রমণকারী ৩০ হাজার নারীর সংগঠন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ বা ভ্রমণকন্যার প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক ও মানসী সাহা। ৩৯তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এ দুজন। এখন অন্যান্য প্রক্রিয়া চলছে। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের একটি প্রকল্প হচ্ছে নারীর চোখে বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের আওতায় দুই বন্ধু স্কুটি নিয়ে দেশভ্রমণ শেষ করেছেন গত ৫ মে। ভ্রমণ শুরু করেছিলেন ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল।
সাকিয়া বললেন, বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে ছেলেদের সঙ্গেও কথা বলা জরুরি। তবে বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত মেয়েরাই কথা বলতে লজ্জা পায়। তাই বিভিন্ন স্কুলের শুধু মেয়েদের সঙ্গেই আলোচনা করা হয়েছে। কোনো স্কুলে মেয়ের সংখ্যা ৪০০, আবার কোনো স্কুলে ৫০ জনও ছিল। তুলনামূলকভাবে শহরের স্কুলের মেয়েরা মাসিক নিয়ে বেশি সচেতন এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে শহুরে মেয়েরাই এগিয়ে আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় না, আবার অনেক পরিবার এত দরিদ্র যে সেই পরিবারের কিশোরীটিকে প্যাড ব্যবহার করতে বলারও উপায় নেই। তাই যে কিশোরীরা কাপড় ব্যবহার করে, তারা যাতে তা ভালো করে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করে, তার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্যাড বা কাপড়, যেটাই ব্যবহার করুক, তা যাতে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর পাল্টায়, তাও বলে দেওয়া হয়। অনিয়মিত মাসিক, মাসিকের সময় পেটে ব্যথা, বেশি রক্ত যাওয়াসহ নানান জটিলতা হলে কিশোরীরা যাতে লজ্জা না পায়, পরিবারের কাছে বলে এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তা বলে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন হাওর এলাকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সাকিয়া জানালেন, নিজেদের ব্যবহার করার জন্যও দোকান থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারেননি তাঁরা।
সাকিয়া জানালেন, তাঁরা যে স্কুলেই গিয়েছেন, সেখানেই তাঁদের ফোন নম্বর, ই-মেইল সব দিয়ে দিয়ে এসেছেন। তাঁরা নিজেরা চিকিৎসক হওয়ার কারণে মাসিকসংক্রান্ত যেকোনো জটিলতায় সঠিক পরামর্শও দিতে পারেন। শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হলে সাকিয়া বা মানসীকে ফোন করে বলে জানালেন।
সাকিয়া নিজের মাসিকের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মাসিকের কাপড় যাতে কেউ কখনো দেখতে না পায়, সে বিষয়ে আমার মা সব সময় আমাকে সতর্ক করতেন। আমিও আমার মায়ের সঙ্গে মাসিকের বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারিনি। আমার আর কোনো ভাইবোন না থাকায় অন্যদের সঙ্গেও পরামর্শ করতে পারিনি। তবে শহরে বসবাস করার কারণে বিভিন্ন বইপত্র পড়ে অনেক বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে পেরেছি, যা প্রত্যন্ত গ্রামের একটি কিশোরীর পক্ষে সম্ভব হয় না।’
সাকিয়া বললেন, ৬৪ বা তার কিছু বেশি স্কুলে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা মাসিক নিয়ে কথা বললেই সব মেয়েরা সচেতন হয়ে যাবে, সেভাবে ভাবলে চলবে না। মাসিক নিয়ে সচেতন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই অন্যদের সচেতন করতে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোরীরা যদি নিজেদের সমস্যার কথা বলার মতো পরিবেশ পায়, তাহলে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তবে অভিজ্ঞতা হলো, অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষকই মেয়েদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে আলোচনা করা পছন্দ করেননি।
সাকিয়া জানান, তাঁর দলের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য স্কুলের কিশোরীদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। সব জায়গায় হয়তো তিনি বা মানসী যেতে পারবেন না, তবে দলের অন্য নারীরা যাবেন।