মাশার গান, আশার গান

মাশা ইসলাম
ছবি: খালেদ সরকার

ছোটবেলায় একবার মাশাকে জোর করে মঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে বলা হলো, ‘একটা গান শোনাও তো!’ আট বছরের ছোট্ট মাশা তখন মাইক ফেলে পালিয়েছিল। সেই মাশা এখন ‘বড়’ হয়েছেন। তাঁর গান এখন লাখো মানুষ শোনে। ইউটিউব, বিজ্ঞাপনচিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজ থেকে সিনেমা—কোথায় নেই মাশা ইসলামের গান!

মাশা এখন আর মঞ্চ ছেড়ে পালান না। বরং মঞ্চই মাশাকে ডেকে নেয়। সম্প্রতি জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড ‘শূন্য’র সঙ্গে ‘বেহুলা’ গানের মহরত অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে গেয়েছেন তিনি। তরুণদের কাছে মাশার গান বেশ জনপ্রিয়। ইউটিউব চ্যানেলে এখন সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দুই লাখ ছুঁই ছুঁই। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর গানের ভিডিও ইউটিউবে ১ কোটি ৩৮ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ মাশার গান শোনেন, নতুন গানের অপেক্ষায় থাকেন; তাঁর ইউটিউব চ্যানেল আর ফেসবুক পেজের মন্তব্যের ঘর দেখলেই সেটি বোঝা যায়। মাশা বলেন, ‘বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের লোকজনের চাপে পড়েই ২০১৬ সালে ফেসবুকে দুটো গান আপলোড করেছিলাম। কিন্তু তখনো আমার মধ্যে অনেক জড়তা ছিল। নিজের চেহারা দেখাব না বলে অডিও গান আপলোড করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, সবাই আমার গান পছন্দ করল। তখন আবার চাপে পড়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেললাম।’

এরপর থেকেই মাশার গান ছড়িয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে। তবে ২০১৯ সালে ভারতের বম্বে জয়শ্রীর গাওয়া ‘জারা জারা’ গানটি নতুন করে গেয়ে আলোচনায় আসেন মাশা। গানটি এখন পর্যন্ত ইউটিউবে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেখেছেন।

মিউজিক্যাল মাশা

শুধু ইউটিউবের গানের ভিউ কিংবা সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দিয়ে মাশার প্রতিভা বিচার করলে একটু অবিচারই হবে। কারণ, বয়সে তরুণ হলেও গানের জগতে মাশা বেশ ‘পুরোনো লোক’। তিনি আট বছর বয়সে ছায়ানটে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রায় ১০ বছর নজরুলগীতির তালিম নিয়েছেন। ২০১২ সালে কামব্যাক উইথ ঝালমুড়ি অ্যালবামে মাশার প্রথম মৌলিক গান বের হয়। তবে এর আগে থেকেই আবহ সংগীতে আর কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পর্দার পেছনে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ডজনখানেক টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের আবহ সংগীত গেয়েছেন। ছোটদের পছন্দের টেলিভিশন অনুষ্ঠান সিসিমপুরের বেশ কিছু গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। এদিকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ইংলিশ ফর টুডে বইয়ের অডিও বুকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন মাশা। এরপর টানা পাঁচ বছর অডিও বুকের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

মাশা ইসলাম

বছর তিনেক আগে সিনেমার প্লেব্যাকে মাশার অভিষেক হয়েছে। ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া রাহশান নূরের বেঙ্গলি বিউটি সিনেমায় দুটি গান গেয়েছেন তিনি। আর হালের ওয়েব সিরিজে হঠাৎ করেই গান গাওয়ার প্রস্তাব পান তিনি।

ব্যক্তিগত একটি গানের রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সঙ্গে মাশার পরিচয় হয়। মাশা বলেন, ‘ফারুকী ভাই তখনো লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান ওয়েব সিরিজের টাইটেল গানের জন্য শিল্পী খুঁজছিলেন। কথায় কথায় তিনি আমাকেই এই গান গাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। আমিও কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। তারপর মাত্র দুই দিনের মধ্যে ফারুকী ভাই গান লিখলেন। চিরকুট ব্যান্ডের পাভেল অরিন ভাই সুর করলেন আর আমি গানটা গাইলাম।’

এদিকে সম্প্রতি গ্রামীণফোনের নতুন গানের খোঁজে ক্যাম্পেইনের বিজয়ী হয়েছেন মাশা। বিজয়ী হওয়ার সুবাদে ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের সুর ও সংগীত পরিবেশনায় ‘মাশার গান’ শিরোনামে মাশার একটি গান বেরিয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন, শুধু ইউটিউবে গান গেয়েই মাশা এত দূর আসেননি। মাশার সঙ্গে যেদিন দেখা হলো, সেদিন তিনি এসেছিলেন স্টুডিও থেকেই। আড্ডা শেষে আবার স্টুডিওতেই ফিরে গেলেন। আড্ডার সময় জানালেন, তাঁর মৌলিক কিছু গানের রেকর্ডিং চলছে। একটা সিনেমার জন্যও গান করছেন। এরপরই মুচকি হেসে বললেন, এর বেশি আর বলা যাবে না।

আপনি কি বাংলাদেশি

মাশা ইসলামের ইনবক্সে প্রায়ই অনেকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কোন দেশের?’ তাঁর ইউটিউব চ্যানেল আর ফেসবুক পেজ মিলিয়ে আটটি ভাষার গান পাওয়া যাবে। তাই হিন্দি গান শুনে কেউ ভাবেন তিনি ভারতীয়, কেউ আবার স্প্যানিশ গান শুনে মনে করেন, মাশার বাবা অথবা মা হয়তো স্পেনের বাসিন্দা।

মাশা একগাল হেসে বলেন, ‘আমি তো এতগুলো ভাষা জানি না। কিন্তু কোনো গান তোলার আগে সেটির পেছনে অনেক সময় দিই। যে ভাষার গান, সেই ভাষা ব্যবহারকারীরা গানটি যেভাবে গাইবেন আমিও ঠিক সেভাবেই গাওয়ার চেষ্টা করি। এ জন্যই হয়তো অনেকে বুঝতে পারে না, আমি বাংলাদেশি।’

বর্তমানে মাশা ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) বিবিএ নবম সেমিস্টারে পড়ছেন। তিনি জানান, ভবিষ্যতে পেশা যা-ই হোক, গানের সঙ্গেই থাকবেন সব সময়। সংগীতের ওপর উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনাও আছে তাঁর। মাশা বলেন, ‘এত দিন পড়াশোনা আর গান যেভাবে সামাল দিয়েছি, ভবিষ্যতে যদি চাকরি করি, তাহলে চাকরি আর গানও সেভাবেই সামাল দেব। তবে গান সব সময় বেশি গুরুত্ব পাবে।’