‘২০১৮ সালের জুলাই মাসের কথা। আটলান্টায় গিয়েছিলাম ফোবানার (দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। স্ট্রিট কারের টিকিট কাটব বলে আটলান্টার সেন্টেনিয়াল অলিম্পিক পার্ক স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ছুটির দিন থাকায় ভিড়ও ছিল অনেক। এমন সময় দেখলাম, আমার সামনে দু–তিনটি বাঙালি পরিবার বারবার চেষ্টা করেও টিকিট কাটতে ব্যর্থ হয়ে অসহায়ভাবে ফিরে যাচ্ছে। আমি তাদের ডেকে নিয়ে সবাইকে টিকিট কেটে দিলাম। তখন থেকেই ব্যাপারটি ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভেতর।’ সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস সিটিতে বসে মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশি তরুণ শফিউল আজম।
বাঙালি পরিবারের যে বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন শফিউল আজম, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, অনেক বাঙালিকেই হয়তো এমন জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষত যাঁরা নতুন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন কিংবা নিতান্তই দর্শনার্থী, ইংরেজি ভাষায় ঠিক ততটা অভ্যস্ত নন, তাঁরা রীতিমতো অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। বাসের টিকিট কাটা, গন্তব্য নির্বাচন প্রভৃতি দৈনন্দিন চলাচলেই বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়।
বাংলাভাষীদের জন্য ভাষাগত এই জটিলতাটি কীভাবে দূর করা যায়, তার একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করেন তিনি। সমাধান আর কিছুই নয়, শহরের বিভিন্ন স্থানে বসানো ডিজিটাল পর্দা বা ‘ইন্টারেকটিভ স্মার্ট কিওস্ক’–এ অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও যুক্ত করে দেওয়া।
কিন্তু কীভাবে করবেন? কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বটি বোঝাবেন কী বলে? না, এত কিছু ভাবতে হয়নি শফিউল আজমকে। মাতৃভূমির মানুষদের প্রতি তীব্র মমতা এবং মাতৃভাষার প্রতি সহজাত দায়বদ্ধতাটি যখন টের পেয়েছেন নিজের ভেতর, তখন কাজটি কঠিন হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া ক্যানসাস সিটির বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের তিনিও যে একজন। নিজের দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন এত দিনে। সুতরাং ব্যাপারটি তাদের বোঝাতে পারবেন বলেই বিশ্বাস ছিল তাঁর।
হ্যাঁ, বোঝাতে পেরেছেন শফিউল আজম। ক্যানসাস সিটিতে প্রায় ছয় হাজার বাঙালির বসবাস। স্মার্ট কিওস্কগুলোতে বাংলা ভাষা যুক্ত হলে এর পূর্ণ সেবা পাবেন তাঁরা। আর ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ (বিআরটি) প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই তো সাধারণ মানুষের যাতায়াতে সার্বিক সেবা নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ক্যানসাস সিটির ৪৬টি স্থানে স্থাপিত হচ্ছে এই ইন্টারেকটিভ স্মার্ট কিওস্ক। ইতিমধ্যে ডাউন টাউনের দুটি স্থানে স্থাপিত হয়েছে। স্প্যানিশ, ফরাসি, চীনা, জাপানি, আরবি প্রভৃতির পাশাপাশি প্রথমবারের মতো সগৌরবে বাংলাও শোভা পাচ্ছে কিওস্কের স্বচ্ছ পর্দায়। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের সন্তান শফিউল আজমের মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধের ফলেই সম্ভব হয়েছে এটি।
শফিউল আজম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যাতায়াতব্যবস্থার অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কীভাবে সেবাটি মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়, গবেষণা করেছেন এ বিষয় নিয়ে। ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সময় কাজের সুযোগ পান ‘ক্যানসাস সিটি এরিয়া ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটিতে, যা পরিচিত ‘রাইডকেসি’ নামে। এর কিছুদিন পরেই ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ প্রকল্পে যোগদান করেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে। যে প্রকল্পেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইন্টারেকটিভ স্মার্ট কিওস্ক।
যেকোনো জায়গায় যাতায়াত, কোনো অনুষ্ঠানস্থল, কনফারেন্স কিংবা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে তথ্য, সব ধরনের যানবাহনের টিকিট কাটা; প্রভৃতি যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য এখন থেকে বাংলায় লেখা থাকবে কিওস্কে। কারও কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়াই একজন বাংলাভাষী স্বাধীনভাবে একাকী এই সেবা ব্যবহার করে ঘুরে বেড়াতে পারবেন শহরের সর্বত্র। ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম স্থানে আছে বাংলা ভাষা। রীতিমতো রক্ত দিয়ে কেনা এই ভাষা। বাংলাদেশিদের সেই আত্মত্যাগের মহিমা সমগ্র পৃথিবীর মানুষ জানে। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভাষাটির ব্যবহার ছিল না! শফিউল আজম বিস্ময় প্রকাশ করেন। ক্যানসাস সিটির মাধ্যমে শুরু। অনুরোধ-উপরোধে নয়; শিগগিরই সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের সব কিওস্কে বাংলা ভাষা যুক্ত হবে স্বমহিমায়, সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।