‘অলসের নাশতা! এখন থেকে সকালের নাশতা পাচ্ছেন আপনার হাতের মুঠোয়।’
দেয়ালে সাঁটা কাগজটায় ইংরেজি আর বাংলার মিশেলে যা লেখা, তার সরল বাংলা অনেকটা এমন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) ক্যানটিনে এই বিজ্ঞপ্তি আমাদের চোখে পড়ল, সঙ্গে ফোন নম্বর। ফোন করে জানলাম, এ উদ্যোগের কান্ডারি রাহুল দ্রাবিড় চৌধুরী। মাভাবিপ্রবিরই গণিতের ছাত্র। এমন একটা আইডিয়া মাথায় এল কেমন করে? রাহুল বললেন, ‘ভোরবেলা উঠে পড়তে বসি। সকাল আটটার দিকে যখন ক্ষুধা লাগে, মনে হয় কেউ যদি নাশতাটা রুমে দিয়ে যেত! এই ভাবনা থেকেই উদ্যোগটা নিই গত বছর ডিসেম্বর মাসে।’ রাহুল ভেবেছিলেন, একটু যাঁরা অলস, তাঁরাই হবেন গ্রাহক। কিন্তু না। পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও ফরমাশ আসা শুরু করল। দেখা গেল, ছেলেদের দুইটি হল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০টি অর্ডার আসে। পরীক্ষার সময় কখনো কখনো সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯০-১০০।
হলের রুমে নাশতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাহুলরা বাড়তি ৩ টাকা করে নেন। ‘ডেলিভারি বয়’ না থাকায় কদিন ধরে সেবা বন্ধ আছে। তবে রাহুল জানালেন, শিগগিরই আবার শুরু হবে।
টাঙ্গাইলের সন্তোষে, মাভাবিপ্রবি প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের এক নিজস্ব জগৎ আছে। এখানে কেউ কেউ রাহুলের মতো পড়ালেখার পাশাপাশি টুকটাক উদ্যোগ নিচ্ছেন। কেউ বা ক্লাসের চেয়ে ক্লাবের কার্যক্রমেই সময় দিচ্ছেন বেশি। কোনো এক গবেষণায় মগ্ন হয়ে লাইব্রেরি অথবা ল্যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকছেন, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও দেখা হলো।
একনজরে—একাডেমিক কার্যক্রম শুরু: ২৫ অক্টোবর ২০০৩, আয়তন: ৫৭.৯৫ একর, অনুষদ: ৬টি, বিভাগ: ১৯টি, শিক্ষক: ২৪৩ জন, শিক্ষার্থী: ৬২৫০ জন, হল: ৭টি
‘বোতল দিন, কলম নিন’—মাভাবিপ্রবির পরিবেশবিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা (ইএসআরএম) বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি উদ্যোগ। ক্লাসে পরিবেশ রক্ষার নানা পাঠ তো আছেই, পাশাপাশি হাতে–কলমেও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্লাসের পড়া কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা কিংবা প্লাস্টিকের পণ্য পুনর্ব্যবহারের বার্তা দিতে বোতলের বিনিময়ে কলম বিতরণ করেন ইএসআরএমের শিক্ষার্থীরা।
বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘পড়ালেখা যে শুধু সার্টিফিকেটের জন্য নয়, এটা আমাদের শিক্ষার্থীরা জানে। চেষ্টা করি ওরা যেন ওদের শিক্ষাটা ক্যাম্পাসেই প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো কোর্সে ক্লাস শেষে আমরা হয়তো ক্যাম্পাস পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিই। ছেলেমেয়েরাও আনন্দ নিয়ে এসব কাজ করে।’ পরিবেশবিজ্ঞানের এই শিক্ষক জানান, তাঁর বিভাগ থেকে বিভিন্ন গবেষণা হচ্ছে। যেমন মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেও কারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য কেঁচো ব্যবহার করে একধরনের ‘ভার্মিফিল্ট্রেশন’ পদ্ধতি তৈরির কাজ করছেন।
কদিন আগে গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) থেকে অনুদান পেয়েছেন মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন। বাংলাদেশের মহিলা বন্দীদের স্বাস্থ্য চাহিদাবিষয়ক এই গবেষণার জন্য দেশের চারটি জেলখানায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মাভাবিপ্রবির বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নুরজাহান খাতুনের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত হয়েছেন। নুরজাহান বলছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগিয়ে এসেছেন। গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজের জন্য আমি যখন সিভি আহ্বান করেছি, প্রথম দফায়ই ৫০টির বেশি সিভি জমা পড়েছে।’
নুরজাহান জানান, সিপিএস বিভাগটি মাভাবিপ্রবিতেই প্রথম চালু হয়েছিল। পুলিশ বা সিআইডি কর্মকর্তা, আইনজীবী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই এই বিভাগে ক্লাস নেন। পড়ালেখার অংশ হিসেবে মডেল থানা, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, সিআইডির বিভিন্ন ল্যাব, পুলিশ একাডেমি ঘুরে দেখার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা।
আমার যেদিন মাভাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা সেদিন সুনামগঞ্জের বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠনে ব্যস্ত। ক্যাম্পাসের প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি ফেরদৌস শান্ত বলছিলেন, ‘এরই মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা উঠে গেছে। আমরা সবগুলো ক্লাব মিলে কাজ করছি।’
এমন মানবিক কাজেই শুধু নয়, যেকোনো উৎসব ও আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলো একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
ক্যানটিনে বসে কথা হচ্ছিল ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ধ্রুবতারা’র সাংগঠনিক সম্পাদক ইসতিয়াক জিয়ন ও ফটোগ্রাফি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মিনহাজুল আবেদীনের সঙ্গে। মিনহাজুল বলছিলেন, ‘ফটোওয়াক, ফটোগ্রাফি কর্মশালা—এ ধরনের আয়োজন তো আছেই। আমরা কিছু ভিন্ন ধরনের কাজও করি। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কিছুদিন আগে আমরা তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ের ১০০টি ছবি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছি।’
বিভিন্ন দিবস বা জাতীয় উৎসবগুলোয় রঙিন হয়ে ওঠে মাভাবিপ্রবি ক্যাম্পাস। একেকটি ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠানে থাকে কনসার্ট। কিন্তু এত সব অনুষ্ঠানের মধ্যে কোন আয়োজনটা সবচেয়ে বড়, কিংবা সবচেয়ে বিশেষ? প্রশ্ন শুনে ইসতিয়াক জিয়ন যে উত্তর দিলেন, সেটা থেকেই এই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ তরুণদের প্রকৃত তাড়নাটা টের পাওয়া যায়। জিয়ন বলছিলেন, ‘কিছুদিন আগে কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আমরা একটা বড় অনুষ্ঠান করেছিলাম। এটা আমার কাছে সবচেয়ে বিশেষ। কারণ এই অনুষ্ঠানের কোনো স্পনসর ছিল না, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা ছিল না। আমরা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে, নিজেদের আগ্রহে এই অনুষ্ঠান করেছি।’
জিয়ন আরও বলেন, ‘আমি নাচ জানি না, গান জানি না। বলতে পারেন, একটা সাংস্কৃতিক সংগঠনে তাহলে আমি করি কী? আসলে মঞ্চের পেছনেও অনেক কাজ থাকে। টাকাপয়সা জোগাড় করা থেকে শুরু করে মঞ্চ তৈরি, সাউন্ড সিস্টেম, আলোর ব্যবস্থা করা... নানা কিছু।’ জিয়ন নিশ্চয়ই জানেন, মঞ্চের পেছনের এসব কাজই একদিন তাঁকে বড় মঞ্চে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
গবেষণা ও পড়ালেখার দিকেই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যেন সেশনজটে না পড়ে, সেদিকেও লক্ষ রাখছি। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির বয়স খুব বেশি নয়। আমিও দায়িত্ব নিয়েছি, খুব বেশি দিন হয়নি। বিশ্বাস আছে, সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে পারব।ড. মো. ফরহাদ হোসেন, উপাচার্য, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়