লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে, আমরা পেয়েছি ভাই মানবজনম। / এই জনম চলে গেলে, আর পাব না–আর মিলবে না।/ তাঁরে হৃদমাজারে রাখিব-ছেড়ে দিব না।
গানের এই কথাগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে মানবজীবনের মূল্য ও মাহাত্ম। পৃথিবীর সব প্রাণীই নিজ নিজ জীবনকে ভালোবাসে। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব প্রাণীই আপ্রাণ চেষ্টা করে। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা তাদের জীবনকে বহুমুখী উপায়ে উপভোগ করে। ঠিক একই কারণে আমাদের জীবনের দুঃখগুলোও বহুমাত্রিক। আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলোও বহুমাত্রিক। এই বহুমাত্রিক চাওয়া-পাওয়া কিংবা সুখ-দুঃখের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে আমরা জীবনযাপন করি। জীবন-ভারসাম্য কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে, না পাওয়া এবং দুঃখের মাত্রা বেড়ে গেলে, আমাদের জীবনে নেমে আসে মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়।
অধিকাংশ মানুষ নিজের মানসিক চেষ্টায়, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু মানুষ সেসব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে তাঁদের জীবনকে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরে কষ্ট ও হতাশার দেয়াল। তাঁরা বন্দী হয়ে যান যন্ত্রণার কারাগারের ভেতর, যেখানে কোনো আলো নেই, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। মানসিক যন্ত্রণার কারাগার থেকে বের হওয়ার বিভিন্ন প্রচেষ্টা যখন বিফল হয় এবং অন্য কোনো সমাধান খুঁজে পায় না, তখন মানুষ এই অন্ধকারকে চিরস্থায়ী ভাবতে শুরু করে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে আশার আলো। ঠিক যে মুহূর্তে আশার আলোটা সম্পূর্ণ নিভে যায়, সে মুহূর্তেই একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে বা আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (২০১৪) মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে!
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে অথবা করতে চায়
একজন মানুষের আত্মহত্যার পেছনে মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান এককভাবে অথবা সামষ্টিকভাবে কাজ করে। তবে চরম বিপর্যয়ের ভেতর থাকা সত্ত্বেও, একজন মানুষের আত্মহত্যা করার বা না করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে নির্ভর করে তাঁর কাছে জীবনের অর্থ, চারপাশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কগুলোকে তিনি কীভাবে দেখেন, বস্তুগত (টাকা-পয়সা, সম্পত্তি, বাড়ি, গাড়ি) ও অবস্তুগত (যশ-খ্যাতি, সুনাম, সম্মান) সম্পর্কগুলোকে তিনি কীভাবে দেখেন, তার ওপর। যাঁরা এসব সম্পর্ককে পরিবর্তনশীল না ভেবে চিরস্থায়ী ভাবেন এবং সম্পর্কগুলোকে সেলফ/আমি–এর অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন, তাঁদের ভেতর বিভিন্ন ধরনের হতাশা, বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি সমস্যা সহজেই তৈরি হয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। কারণ, এ ধরনের জীবনদর্শনের মানুষের চিন্তাগত নমনীয়তা এবং প্রাকৃতিক নিয়ম তথা পরিবর্তনকে গ্রহণ করার সক্ষমতা কম থাকে।
ব্যক্তিজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা বিবেচনার ক্ষেত্রে যাদের নিজস্ব কোনো মানদণ্ড থাকে না, বরং বাইরের/সমাজের মানদণ্ড দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, তাঁদের ভেতর পরিবেশগত মানসিক চাপ বেশি কাজ করে। এই ধরনের মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য অনেকে আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেসব মানুষ আত্মহত্যা করে, তারা মূলত শরীরকে হত্যা করতে চায় না, বরং মনের ভেতর জমে থাকা পাহাড়সমান কষ্ট ও বেদনাকে হত্যা করে মানসিক কারাগার থেকে মুক্তি পেতে চায়।
আত্মহত্যাকারী বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, এমন মানুষের ভেতর নিজের প্রতি ঘৃণা, অন্যের প্রতি ঘৃণা অথবা চারপাশের পরিবেশের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণাভাব কাজ করে। এই নেতিবাচক মনোভাব একজন মানুষকে নিজের ক্ষতি করতে অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। এ ছাড়া এসব মানুষের ভেতর আবেগের পরিপক্ষতা, নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য কম থাকে। দীর্ঘদিনের দুর্বল পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক সম্পর্ক মানুষের ভেতর একধরনের অস্তিত্বজনিত শূন্যতা তৈরি করে, যা সামাজিক মাধ্যমের লাখ লাখ ফলোয়ার কিংবা অর্থ–সম্পদের প্রাচুর্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না। এ ধরনের শূন্যতা জীবনকে ভীষণ অর্থহীন করে তোলে। জীবনের অর্থহীনতা আত্মহত্যার ইচ্ছাকে বেগবান করে।
আত্মহত্যার পূর্ব লক্ষণ
আত্মহত্যা কোনো রোগ নয়, বরং একটি সিদ্ধান্ত। তাই আত্মহত্যার নির্দিষ্ট কোনো পূর্ব লক্ষণ নেই। অনেক মানুষের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পূর্ব পর্যন্ত তেমন কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণই দেখা যায় না, যা থেকে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও বোঝা যাবে যে লোকটি মনে মনে আত্মহত্যার চিন্তা করছেন। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে আত্মহত্যার আগে সচরাচর কিছু মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন ঘটে, যা খুব নিবিড়ভাবে এবং সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে হয়তো চোখে পড়বে না।
একজন মানুষের আত্মহত্যার আগে তাঁর ভেতর বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দেয়। সব সময় হতাশামূলক কথাবার্তা বলে। কথাবার্তায় ও কাজে মৃত্যু প্রসঙ্গ বেশি উঠে আসে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে হঠাৎ গুটিয়ে নেয়। মেজাজ-মর্জির দ্রুত পরিবর্তন দেখা যায়। নিজেকে অন্যের বোঝা মনে করেন। শক্তিশালী কোনো এক ফাঁদে আটকে পড়ার কথা বলে। নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যায়। একেবারেই ঘুম হয় না অথবা অতিরিক্ত ঘুমায়। খাওয়াদাওয়া এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অনিয়ম দেখা যায়, যা আগে ছিল না। চরিত্রে হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়। এমন কিছু কাজ করে বা এমন ধরনের কথা বলে, যা দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আত্মহত্যাকারী সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নেতিবাচক ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে যায়। যেমন, প্রিয়জনের মৃত্যু, সম্পর্কের ছেদ, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, চাকরি চলে যাওয়া ইত্যাদি।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায়
আত্মহত্যা কারও কাম্য নয়। কাছের কোনো মানুষ আত্মহত্যা করুক, সেটাও কেউ চায় না। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আত্মহত্যাকারীও কাছের পরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য খুঁজে বেড়ায়। কারণ, কেউ আসলে অকালে মরতে চায় না। আত্মহত্যার পূর্ব লক্ষণগুলো বিবেচনায় রেখে আপনি যদি বুঝতে পারেন যে কাছের কেউ একজন আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছেন, তবে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আন্তরিকতার সঙ্গে এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
তবে যে বিষয়টা অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা হলো, কথা বলতে হবে কম, শুনতে হবে বেশি। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনলে তাঁর ভেতরের কষ্ট প্রকাশ করার ক্ষেত্র তৈরি হবে। কথা বলার সময় নিজের ব্যক্তিগত মতামত দেওয়া যাবে না। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত, তা বলা যাবে না। এতে বিপরীত পক্ষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারবে না। তাই বিপরীত পক্ষের অনুভূতিগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং কথা বলার মাধ্যমে বের করে আনতে হবে তিনি আসলেই আত্মহত্যা–সংক্রান্ত কোনো পরিকল্পনা করছেন কি না।
যদি পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্য বা কাছের কোনো মানুষকে বিষয়টি জানাতে হবে। পরিবারের কেউ বা ঘনিষ্ঠ কেউ পৌঁছার আগ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকতে হবে। আশপাশে দড়ি, বিষ, ব্লেড, চাকু, বন্দুক, হারপিক ইত্যাদি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। তাঁকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সার্বক্ষণিকভাবে কারও তত্ত্বাবধানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
এখন কথা হলো, আমার–আপনার যদি আত্মহত্যার চিন্তা আসে অথবা অনেক দিন ধরে আত্মহত্যার চিন্তা মনের ভেতর ঘুরপাক খায়, তাহলে কী করব? নিজের পরিবারের, পরিবারের বাইরের কাছের মানুষকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা জানাতে হবে, যা ব্যবহার করে আত্মহত্যার চিন্তা করছেন, সেটা কোনোভাবেই ঘরের ভেতর রাখা যাবে না। অবশ্যই প্রফেশনাল মনোচিকিৎসকদের কাছ থেকে ওষুধের সাহায্য নিতে হবে, মনোবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে নিয়মিত সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং নিতে হবে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যত বেশি সম্ভব সময় কাটাতে হবে। সামাজিক সম্পর্কগুলোর আরও বেশি যত্ন নিতে হবে। কোনোভাবেই একা থাকা যাবে না। যেসব সমস্যা আত্মহত্যার চিন্তাকে প্রাথমিকভাবে উসকে দিচ্ছে, সেসব সমস্যা এবং সমস্যার উৎসকে সাময়িকভাবে এড়িয়ে চলতে হবে এবং মনোযোগের বাইরে রাখতে হবে। আপনার জীবনের যেসব বিষয় আপনাকে নির্মল আনন্দ দেয় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সে বিষয়গুলোতে বেশি সময় দিতে হবে। সময়মতো খাবার খেতে হবে। নিয়মিত ঘুমাতে হবে। শারীরিক অনুশীলন বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
কারও আত্মহত্যার জন্য শুধু আত্মহত্যাকারী একা দায়ী থাকেন না। বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী থাকে। তাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার যেসব আচরণ বা নিয়ম একজন ব্যক্তিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, সেসব আচরণ এবং নিয়মনীতি সম্পর্কেও আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, সেগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে। সেই পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হোক আপনার হাত ধরেই।
লেখক: মনোবিজ্ঞানী ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত