হাঁটু ভেঙে নিচে বসে থাকা এক নারীমূর্তি। কান্নার দমক আটকাতে এক হাত দিয়ে মুখ ঢাকা, অন্য হাতটা বুকের কাছটায় জামা খামচে ধরা। সামনে একটি মেয়েশিশু এক পা উঁচু করে ওই নারীর মাথা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। অদেখা এক সন্তানের জন্য মুষড়ে পড়া মা আর অন্য কোনো জগৎ থেকে সেই শিশুর মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টার হৃদয়স্পর্শী এক চিত্র। শিশুটিকে আলাদা ধাতুতে গড়ে স্পষ্ট করা হয়েছে পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব না থাকার বিষয়টি।
যেসব শিশু কখনো জন্ম নেয়নি সেই শিশুদের স্মরণে স্লোভাকিয়ার ভাস্কর মার্তিন গুদাচেক ‘মেমোরিয়াল ফর আনবর্ন চিলড্রেন’ শিরোনামের এই ভাস্কর্য তৈরি করেন। গর্ভে ধারণ করলেও শেষ পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিতে না পারার এমন ঘটনা বিশ্বজুড়ে অনেক ঘটেছে, ঘটে চলেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বসবাসকারী এক মা জানালেন, তাঁর প্রথম গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের সময় গর্ভপাত হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের পর মন খারাপ ভাবটা চলে গিয়েছিল। তাঁর মেয়ের বয়স এখন ছয় বছর। দুই বছর আগে মেয়েকে স্কুলে ভর্তির সময় সাক্ষাৎকারে ‘এটাই একমাত্র সন্তান কিনা’ এমন প্রশ্নের মুখে হঠাৎ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েন।
আরেক মা জানালেন, প্রথম সন্তানের যখন দুই বছর তখন তিনি আবার গর্ভধারণ করেন। তবে ১৩-১৪ সপ্তাহের সময় একদিন বাসায় পা পিছলে পড়ে যান। দ্রুত ছুটে যান হাসপাতালে। চিকিৎসক জানান, তাঁর গর্ভপাত হয়ে গেছে। এরপর তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। চাকরি করতেন, সেটিও ছাড়তে হয়। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবারও সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন।
সরকারি-বেসরকারি হিসাবে মাসিক নিয়মিতকরণ বা মেন্সস্ট্রুয়াল রেগুলেশন (এমআর) গ্রহণকারী নারীদের সংখ্যাকে গর্ভপাতের সংখ্যা হিসেবে ধরা হয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বছরে ২১ লাখ ৯০ হাজার প্রসবের ঘটনা ঘটে। আর গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে আড়াই-তিন লাখ।
তবে দেশে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের ঘটনা ঠিক কত ঘটে, সে সম্পর্কে কোনো হিসাব নেই।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানালেন, গর্ভাবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ভ্রূণের প্রথম ১২ সপ্তাহ, ভ্রূণের ১২ থেকে ২৪ সপ্তাহ এবং ২৪ সপ্তাহ থেকে ৪০ সপ্তাহ। ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় ভ্রূণ গর্ভে না টিকলে সেটিকে গর্ভপাত বলা হয়। স্বাভাবিকভাবে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষেত্রে যেকোনো নারীর গর্ভপাত হতে পারে। তবে মোট গর্ভপাতের ৮০ শতাংশই ঘটে প্রথম ১২ সপ্তাহে। সে ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশই ঘটে ভ্রূণের জেনেটিক বা ডিএনএঘটিত ত্রুটির কারণে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, গর্ভাবস্থায় ভেজাল খাবার খাওয়ার কারণে অনেক মায়ের গর্ভপাত ঘটে যায়। এর বাইরেও পরিবেশদূষণ, মানসিক চাপ, পারিবারিক নির্যাতন, অশান্তি, কর্মজীবী মায়েদের যাত্রাপথের ঝক্কি, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত ‘মান অজানা: পানির অদৃশ্য সংকট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, লবণাক্ত পানি পান করার কারণে উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারীকে অকাল গর্ভপাতের শিকার হতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বললেন, এমন অনেক মা চিকিৎসকদের কাছে আসেন, যাঁদের রুবেলা, টক্সোপ্লাজমার মতো সংক্রমণ, কালা জ্বর বা ডেঙ্গুর মতো জ্বরে আক্রান্ত হওয়া বা একের অধিক ভ্রূণ জরায়ুতে থাকার কারণে গর্ভপাত ঘটে গেছে। ১৮ বছরের কম বা ৩০ বছরের বেশি বয়সী মায়েদের গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, অধিক ওজন, যক্ষ্মার মতো দীর্ঘ মেয়াদে কোনো অসুখে ভুগলে বা ক্যানসারের মতো রোগে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণ করলে, যেকোনো সাধারণ অসুস্থতায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যথেচ্ছ ওষুধ ব্যবহার, বন্ধ্যত্বের কারণে চিকিৎসা নিয়ে যাঁরা মা হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের হার অনেক বেশি।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফৌজিয়া ইয়াসমিন বললেন, কোনো আঘাত বা দুর্ঘটনা, স্বামী বা স্ত্রীর শারীরিক সমস্যা থাকলে গর্ভপাত ঘটতে পারে।
গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা আছে এমন মায়েরা বলছেন, গর্ভপাত–সংক্রান্ত জটিলতা ও উদ্বেগ মাতৃত্বকে অনিরাপদ করে তোলার পাশাপাশি অব্যক্ত এক ক্ষতের সৃষ্টি করছে, যা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জীবনভর।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ইতালির সাংবাদিক, লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির বিখ্যাত লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন বইয়ে অদেখা সন্তানের সঙ্গে মায়ের কথোপকথন প্রসঙ্গে বলা হয়, ফাল্লাচি নিজের জীবন থেকেই লিখেছেন বইটি। জন্ম না নেওয়া সেই সন্তানের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘তুমি না ঈশ্বর, না রাষ্ট্র, না আমার। তুমি শুধু তোমারই, আর কারও নও।’