বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ঘোষণা দিয়েছিলেন, চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে তাদের উড়োজাহাজে বাড়ি নিয়ে যাবেন। ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজকে হারিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয় দল সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হলো, কিন্তু সেদিন আর উড়োজাহাজের টিকিট পাওয়া গেল না। উড়োজাহাজে যেতে হলে আরেকটি দিন ঢাকায় থাকতে হবে। কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরা জরুরি। এখন ধান কাটার মৌসুম। বাড়ি ফিরেই ফসলের মাঠে যেতে হবে কাজে।
মাঠে এমন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেই তারা স্কুলে পড়ে। মাঠের ফসল কেটে সে মাঠেই আবার ফুটবল খেলে। এই অদম্য কিশোরেরাই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহযোগিতায় ‘ক্লিয়ার মেন’ আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্টে দেশসেরা হয়েছে। ১২ মে ঢাকার কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই ফুটবল টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। ‘ক্লিয়ার মেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ’ নামে এই প্রতিযোগিতায় সারা দেশের ১৭২টি হাইস্কুল অংশ নেয়। ক্রীড়াশিক্ষকহীন সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু চ্যাম্পিয়নই হয়নি, সর্বোচ্চ গোল দিয়ে জিতেছে গোল্ডেন বুট, দলের একজন হয়েছে ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’। এই দুজনকেই জাতীয় দলে (অনূর্ধ্ব-১৭) খেলার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
সবাই গেছে মাঠে
রাজশাহী শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের ধারেই সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয়। আশপাশের ১১ গ্রামের শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তাদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অভাবী পরিবারের ছেলেমেয়ে। ফুটবল দলেও তাদের অংশগ্রহণ বেশি। যেমন চ্যাম্পিয়ন দলটির সদস্যদের নাম— জগেন লাকড়া (অধিনায়ক), প্রবিত কুমার, হেমন্ত টপ্পো, বিপ্লব তিরকি, রাজীব কুমার, অন্তর কুমার, কৃষ্ণ সরদার, রিপন ওঁরাও, চান সওদাগর, আবু নুর ইউসুফ, মুরসালিন, আলিম রানা ও তাজিমুল হক। এদের মধ্যে চান সওদাগরকে ঢাকার মাঠে নামানো হয়নি। এ ছাড়া আশিক ইকবাল ও মোত্তালেব হোসেন মাঠে প্রস্তুত ছিল। চান সওদাগর অষ্টম শ্রেণিতে আর রাজীব, কৃষ্ণ, অন্তর, বিপ্লব, হেমন্ত ও প্রবিত নবম শ্রেণিতে। বাকিরা দশম শ্রেণিতে পড়ে।
২২ মে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, খেলার সাফল্যের সঙ্গে বিদ্যালয়ের চেহারার মোটেও মিল নেই, বরং শিক্ষার্থীদের পরিবারের মতোই বিদ্যালয়টির চেহারা। এত দিন ধরে শিক্ষার্থীরা মাটির ঘরে ক্লাস করেছে। সম্প্রতি তাদের বিদ্যালয়ে একটি পাকা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কোনো আলাদা কার্যালয় নেই। একটি কার্যালয়ের মাঝখান আলমারি দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয় আলাদা করা হয়েছে। আগে থেকেই প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু বিদ্যালয়ে গিয়ে ফুটবল দলের সবাইকে পাওয়া গেল না। প্রধান শিক্ষক মাইনুল ইসলাম বললেন, ‘অধিনায়কসহ এই ফুটবল দলের নয়জনই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। তারা খুবই অভাবী পরিবারের ছেলে। মাঠে না খাটলে তাদের চলে না।’ তাই বিদ্যালয়ে গিয়ে অধিনায়ক জগেন লাকড়াকে পাওয়া গেলেও ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ প্রবিত কুমারসহ আরও কয়েকজনকে পাওয়া গেল না। তারা দূরে পেয়ারাবাগানে কাজে গেছে।
স্কুল থেকে অধিনায়ক জগেন লাকড়ার বাড়িতে গিয়ে তার মা প্রমীলা লাকড়াকে পাওয়া গেল। সদ্য মাঠ থেকে ফিরলেন। কিছুক্ষণ বসার পর বাবাও ফিরলেন। মা বললেন, ‘ছেলেকে টেলিভিশনে দেখেছি। ছোটবেলা থেকেই শুধু খেলে। বকাবকি করতাম। আমরা গরিব মানুষ। তবু খেলা ছাড়ে না। আপনারা ওর জন্য দোয়া করবেন।’
ওদের খেলা দেখবে বলে
সোনাদীঘি গ্রামের মুদিদোকানি রেজাউল হক বললেন, সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয় ফাইনালে উঠেছে খবর পেয়ে খুশির বন্যা বয়ে যায় পাশের ১১ গ্রামে। কেমন সেটা? তিনি জানালেন, গ্রামের টেলিভিশনে ‘ডিশ’ সংযোগ ছিল না। কোথা থেকে খবর রটে গেল যে সোনাদীঘি স্কুলের ছেলেরা ঢাকায় কমলাপুর স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলবে। গ্রামের মানুষের সেদিন আর কোনো কাজ রইল না। যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে খাটে। তার মধ্যে ধান কাটার মৌসুম। তবু তাঁরা সেদিন আর কোনো কাজে গেলেন না। সবাই দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন কীভাবে গ্রামে ডিশ লাইনে সংযোগ দেওয়া যায়। ডিশ ব্যবসায়ীকে খবর দেওয়া হলো কিন্তু আসি-আসি করে তিনি আর এলেন না। গ্রামের মানুষ দিশেহারা হয়ে গেলেন। তখন একজন টেলিভিশন মেকারকে তাঁরা ডিশলাইন সংযোগ দেওয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা খেলা দেখতে পেয়েছিলেন। রেজাউল হক বললেন, সেদিন গ্রামে যেন উৎসব হয়ে গেল।
ওরা এখন তারকা
সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ের খুদে ফুটবলাররা এখন আশপাশের গ্রামে তারকা বনে গেছে। যেখানেই যাচ্ছে তারা এখন আলাদা সম্মান পাচ্ছে। সবাই সমীহ করছে। দেখা হলেই ডেকে কথা বলছে। গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পালান্ত সরদার যেমন বললেন, ‘দলের সদস্যদের এলাকার মানুষ অন্য চোখে দেখছেন। ওরা গোল্ডেন বুট জিতে এনেছে। ওরা এখন আমাদের গ্রামের সোনার ছেলে। ওরা শুধু গ্রামের নয়, গোদাগাড়ী উপজেলার গর্ব।’ তিনি আরও জানান, এলাকার মানুষ কোনো দিন চিন্তাও করতে পারেননি যে মাঠে খেটে খাওয়া এই ছেলেরা তাঁদের এলাকার জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনবে। সোনাদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ের নামটা তারা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে এলাকার মানুষের কাছ থেকে তারা এই ভালোবাসা পাচ্ছে।