কোভিড মহামারি শেষ না হতেই বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স। ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ নিয়ে সতর্ক করেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬টি দেশে রোগটি ছড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে নানা গুজব আর ভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। যেকোনো রোগ সম্পর্কে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা ও জ্ঞান আমাদের সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে। তাই অকারণ আতঙ্কিত না হয়ে বা বিভ্রান্ত না হয়ে মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন ও সচেতন হোন।
কোভিড-১৯ ছিল একটি নতুন ধরনের ভাইরাস, যা সম্পর্কে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আগে বিজ্ঞানীদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। মাঙ্কিপক্স কিন্তু নতুন কোনো রোগ নয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম এ রোগ সম্পর্কে জানা যায়। তখন এটি বানরের মধ্যে দেখা যেত। ১৯৭০ সালে আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো রিপাবলিকে প্রথম মানুষের মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। তারপর থেকে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ যেমন কঙ্গো, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, গ্যাবন, সিয়েরা লিওন প্রভৃতি দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণের কথা শোনা যায়। তবে আফ্রিকার বাইরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব তেমন ছিল না।
নাম শুনে অনেকেরই ধারণা হতে পারে যে এ রোগ বুঝি শুধু বানর থেকেই ছড়ায়। আসলে তা নয়। রোগটি প্রথমে বানরের মধ্যে দেখা দিয়েছিল বলে এর নাম মাঙ্কিপক্স। ইঁদুর, কাঠবিড়ালি ইত্যাদি প্রাণী থেকেও মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। এটি একধরনের জুনোটিক ডিজিজ, মানে প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। আক্রান্ত প্রাণী বা ব্যক্তির দ্বারা দূষিত ব্যবহার্য বস্তু যেমন তোয়ালে, পোশাক, চাদর স্পর্শ করার মাধ্যমে বা ড্রপলেট (শ্বাস–প্রশ্বাস) থেকে একে অপরকে সংক্রমিত করে ভাইরাস।
এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাস অর্থোপক্স গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এককালের আতঙ্ক স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলাও এই গোত্রের ভাইরাস।
অনেকটা গুটিবসন্তের মতো হলেও মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ মৃদু। শুরুতে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি দেখা দেয়। ফুলে যেতে পারে লসিকা গ্রন্থি। এক থেকে তিন দিনের মধ্যে সারা গায়ে ফুসকুড়ি ওঠে। মুখে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এই ফুসকুড়ি। বসন্তের মতোই প্রথমে লাল, তারপর ভেতরে জলপূর্ণ দানা, শেষে শুকিয়ে পড়ে যেতে থাকে। দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয় এই রোগ। তারপর নিজে নিজেই সেরে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো জটিলতা হয় না।
মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ বলে আপনা থেকেই সেরে যায়, তেমন কোনো চিকিৎসার দরকার পড়ে না। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা যেমন জ্বর বা শরীরব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, প্রচুর পুষ্টিকর খাবার ও পানি গ্রহণ, বিশ্রাম ইত্যাদিই হলো চিকিৎসা। অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা কার্যকর, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ রোগের জন্য অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসার কোনো নির্দেশনা নেই। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ গ্রহণের দরকার নেই।
সবে একটি অতিমারি সামলে উঠছে সারা বিশ্ব। অর্থনীতিসহ নানা দিক দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে গত তিন বছরে। এই মুহূর্তে কেউ চায় না যে আরেকটি রোগ বা সংক্রমণ আবার জনজীবনকে নাজেহাল করে তুলুক। তাই মৃদু হলেও যেকোনো সংক্রামক রোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে দেশে আর যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা নেই, সমগ্র বিশ্বে গণচলাচল বিদ্যমান। তাই এক দেশের ভাইরাস আরেক দেশে সহজেই প্রবেশ করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই সবারই সচেতন থাকা উচিত।
যেকোনো ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। তাই মাস্ক পরুন, বারবার সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখুন। বিশেষ করে পশুপাখি বা অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন, হাঁচি-কাশির আদবকেতা মেনে চলুন।
মৃত বা অসুস্থ পশুপাখির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। জ্বর, কাশি, শরীরব্যথা বা ফুসকুড়ি আছে এমন ব্যক্তির থেকে আলাদা থাকতে হবে। অসুস্থ অবস্থায় ভ্রমণ করবেন না বা কাজে বা স্কুল–কলেজে যাবেন না। অসুস্থ হলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে আলাদা থাকুন। কারও ব্যক্তিগত জিনিস যেমন তোয়ালে, রুমাল, বালিশ, চাদর অন্যজন ব্যবহার করবেন না। জ্বরাক্রান্ত রোগী যেন ভ্রমণ না করেন, সেদিকে সতর্কতা বাড়াতে হবে।
ব্যাপক টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্স বহু আগেই বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্সের বিপরীতে ৮০-৮৫ শতাংশ কার্যকর। কিন্তু গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে বলে বর্তমানে এই টিকা আর কাউকে দেওয়া হয় না। মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে টিকা রয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত গণহারে টিকা ব্যবহারের কোনো নির্দেশনা নেই। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতাই এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে সহায়ক।