মহারাজা, তোমারে সেলাম!

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

বাবার সঙ্গে লেখক

সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবা কাজে যেত। আমরা তিন ভাইবোন তখন একদম ছোট। মাসহ আমরা সারা দিন বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের অপেক্ষা দুপুর থেকে বিকেল, আর বিকেল থেকে সন্ধ্যায় গড়াত। বাবা আসে না। এ এক দারুণ অপেক্ষা বাবার জন্য। মা সন্ধ্যার আগেই বাসনকোসন, হাঁড়িপাতিল পরিষ্কার করে রান্নার জন্য প্রস্তুত করে রাখতেন সবকিছু। বাবা কাজ করে যে টাকা পাবে, সেই টাকার চাল কিনে আনলেই আমাদের রান্না বসবে। সন্ধ্যা হয়, বাবা আসে না। মা কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে আমাদের বই পড়তে বলে। আমরা দুই ভাই–বোন কুপি জ্বালিয়ে বই পড়ি আর বাবার জন্য অপেক্ষা করি। আমার ছোট বোনটা এক সময় ক্ষুধায় কান্না শুরু করে দেয়। আমরা নাহয় একটু হলেও বুঝি, তাই চুপচাপ থাকি। কিন্তু ও তো আর বোঝে না। একসময় ও কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরাও ক্লান্ত হয়ে উঠি। বাবা আসে না। কুপির সোনালি আলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি।

খুব সকালে আমার মাথায় কে যেন হাত বোলায়। আর হালকা সুরে ‘রাজকুমার, এ রাজকুমার...’ বলে ডাকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা। বাবা আমাকে রাজকুমার আর বোনদের রাজকন্যা বলে ডাকে। আমাদের তিন ভাইবোনকে ডেকে তুলে, কোলে নিয়ে চটের বস্তায় বসিয়ে দেয়। আমি ঘুম ঘুম চোখ ডলতে ডলতে দেখি, মা আমাদের থালে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত তুলে দিচ্ছে।

বাবা, তুমি কি জানো তুমি আমার জীবনে কী? কোন ভাষায় প্রকাশ করব, খুঁজে পাই না!

আমি সেদিন থেকেই লড়াই করা শিখে গেছি, জানো? আমি সেদিন থেকেই দিগ্‌বিদিক ছুটি হার না মানার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে, যেদিন আকাশ ঘন কালো মেঘের কুণ্ডলীতে ভরে গেল। সেই চিরচেনা ভয়ংকর কালবৈশাখী! এ কালবৈশাখী আমাদের জন্য মহা আতঙ্কের ছিল। এ ঝড়েই আমাদের নড়বড়ে দুই চালার ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। আমাদের হাহাকার বেড়ে যেত। কিন্তু সেদিন ঘটল অন্য ঘটনা।

ঝড় এলেই আমরা ভয়ে বাবার কাছে ছুটে যাই। বাবাও আমাদের দুই হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর বলে, ‘ভয় করিস না। কিচ্ছু হবে না।’ আমরা বাবার বুকে থাকায় বাবার হৃৎস্পন্দন টের পাই, তার নাকের গরম নিশ্বাস পড়ে আমাদের মাথায়।

ঝড়ের গতি বেড়ে যায় একসময়। এই ঘরের চালা উড়ে গেল বলে! বাবা আমাদের ফেলে ছুটে যায়, ঘরের চালা শক্ত করে ধরে রাখে। আর আমরা ভয়ে চিৎকার করি। এরপর বাবার সঙ্গে মা যায়। আমিও যাই। ঝড় না থামা পর্যন্ত ঘরের চালা ধরে ঝুলে থাকি আমরা সবাই।

কালবৈশাখী সেদিন আমাদের কাছে হেরে গিয়েছিল। ঠিক এভাবেই লড়াই করে চলছি বাবা! তোমার লড়াই করার শিক্ষায় আমি অটল! মচকাব, তবু ভাঙব না।

আমি মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাস থেকে বাড়িতে গিয়ে ঘরের ভাঙাচোরা বেড়াগুলো ঠিক করে দিই। আমাদের রান্নাঘরের দুই দিকের বেড়া ঠিক করা হলেও সামনের দিকের বেড়াগুলো আমার কোনো দিন ঠিক করা হয়ে ওঠে না। কারণ, বাবা চায় না। যেন ঝড় বৃষ্টির সময় কুকুর–বিড়াল এখানে এসে আশ্রয় নিতে পারে। আমি অবাক হয়ে যাই! বাবা রাতে যখন কোথাও থেকে বাড়িতে আসে, তখন তার হাঁটার শব্দ শুনেই আমাদের বাড়ির আশপাশের কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, হাঁস, কবুতরসহ অন্যান্য প্রাণী কেঁদে ওঠে! আমার বাবাকে সৃষ্টিকর্তা এ এক আশ্চর্য সৌন্দর্য দিয়েছেন, যা আমাকে অনেক অনেক কিছু শেখায়, ভাবায়, আপ্লুত করে, আনন্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে!

বাবা, তোমাকে লবণ ছাড়া পান্তাভাত দিলেও হাপুস–হুপুস করে খেয়ে নাও কিছু না বলে। তুমি এত সহজ–সরল কেন! কী সাধারণ তোমার জীবন। কোনো দিন তোমাকে কোনো বিষয়ে আফসোস করতে দেখিনি। তোমার এক অসাধারণ শক্তি আছে, বাবা—মুখে সব সময় হাসি রাখার শক্তি! অল্পতেই তুমি অনেক অনেক খুশি থাকো। যেন চার আনা তোমার পকেটে থাকলেই রাজা আর আট আনা থাকলেই সম্রাট! তোমাকে শত হাজার লক্ষ কোটি সেলাম!