লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এক বক্তৃতায় তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি খেয়াল করেছেন, ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগের ও পরের শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগে বিশাল ফারাক আছে। আগের তুলনায় এখনকার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কম মনোযোগী। কারণ কী? ইন্টারনেট। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুক; পলকে পলকে যেখানে নতুন তথ্য, নতুন ছবি ভেসে বেড়ায়। কোনো কিছুতেই মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ নেই। ভার্চ্যুয়াল এই অভ্যাস বাস্তবেও প্রভাব ফেলছে।
গবেষণা যা বলে
গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটির অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিইউ টুডে-তে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে শিক্ষার্থীদের একটি চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মিনিট সামনে ফোন রেখে বসে থাকতে হবে, কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু সামনে ফোন রেখে সব শিক্ষার্থীই এমন উসখুস করতে থাকলেন যেন কোনো ভয়ানক নেশাদ্রব্যের অভাব বোধ করছেন! ব্যাপারটি আসলে নেশার মতোই হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে গ্লোবাল ডিজিটাল স্ট্যাটশট অব কিউটুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকে সক্রিয় ব্যবহারকারীর মধ্যে ঢাকা শহর দ্বিতীয়। জরিপ চালানোর সময় দেখা যায়, ঢাকায় এক মাসে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৯ কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশই যে তরুণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তরুণদের বেশির ভাগই আবার শিক্ষার্থী, এতেও দ্বিমতের অবকাশ নেই। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রকাশনা সংস্থা এমআইটি প্রেস একটি গবেষণাগ্রন্থ বের করেছে। বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যাডাম গ্যাজালি ও মনোবিজ্ঞানী ল্যারি ডি. রোজেনের লেখা বইটির নাম দ্য ডিসট্র্যাকটেড মাইন্ড: অ্যানসিয়েন্ট ব্রেইনস ইন আ হাই-টেক ওয়ার্ল্ড। বিপুল পাঠকপ্রিয় এই বইয়ে বলা হয়েছে, দোষ ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনের নয়, সমস্যা আমাদের মস্তিষ্কে।
অভিজ্ঞতা যা বলে
সদ্যই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন দেবাদ্রিতা হালদার। অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘ইন্টারনেট বা ফোনের কারণে মনোযোগে সমস্যা হচ্ছে, এটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমি নিজেও এসব খুব বেশি ব্যবহার করতাম। কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে সবকিছু বন্ধ রাখলাম। প্রথম কয়েক দিন খুব সমস্যা হলো। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখলাম, অভ্যাস হয়ে গেছে। শুধু ফোনের দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই। নিজের মনটাকে ঠিক করতে পারলেই সমাধান আছে।’
সমাধানের পথগুলো আরও ভালো করে দেখিয়ে দিলেন লেখক-শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সমাধানের এই পথ তিনি চিনে এসেছেন সেই বাল্যকালেই, ‘আমাদের সময়ে বস্তুর বাহুল্য ছিল না। বই ছিল বড় সঙ্গী। খেলার মাঠে খেলতে যেতাম প্রতিদিন। সেখানে খেলাধুলা করতে করতে সত্যিকারের বন্ধুত্ব হতো। খেলতে খেলতে ঘেমে যেতাম। তারপর বাসায় গিয়ে মনে হতো, পড়াটা পড়েই ফেলি। তা ছাড়া বড়দের কড়া শাসনও ছিল। আর সারা দিনের ক্লান্তির পর রাত ১২টার আগে ঘুমাতেই হতো। মোটকথা বই পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, বড়দের শাসন এবং শারীরিক শ্রমের কারণে মনোযোগের চর্চা হয়ে যেত। এখন দৃশ্যমাধ্যম প্রবল। রাত জাগাটাই নিয়ম। পরিবার ও বাস্তব বন্ধুত্বের বন্ধন শিথিল। টিভি-ফেসবুকের এত চমকের ফলে বিক্ষিপ্ততা বাড়ছে। পড়াশোনা এখন মুখস্থনির্ভর। মুখস্থ করার এই পদ্ধতি মনোযোগ বাড়ায় না; যান্ত্রিক মানুষ তৈরি করে। এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না।’
বাস্তবতা যা বলে
কেবল শিক্ষার্থীদের দোষই নয়, শিক্ষকদের দায়ের কথাও মনে করিয়ে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম, ‘ইন্টারনেট-ফেসবুকপ্রীতি তো আছেই। আবার সব শিক্ষক যে ভালো পড়ান, তা-ও কিন্তু না। অনেক শিক্ষকই আছেন, যাঁদের লেকচার আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। ফলে শিক্ষকদের উপস্থাপনারও বিশাল একটা ভূমিকা আছে।’
এই যুক্তিও মানেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ‘এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ভালো ফলের দিকে নজর দেন বেশি। কিন্তু আমাদের সময় শিক্ষকদের গুণে সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটিও মনোযোগ দিত। একইভাবে পরিবারের বড়দেরও ভূমিকা আছে। সন্তানকে বাজারের জন্য তৈরি না করে মানুষ করার চেষ্টা করতে হবে। আর কল্পনা রুদ্ধ করলে মনোযোগ অসম্ভব। রসায়নের বই পড়লেও আমরা জিনিসটা কল্পনা করতাম। কিন্তু এখনকার শিক্ষানীতি সেই কল্পনা রুদ্ধ করে দিচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫০ বার ফোন খুলে দেখে। এই তাড়না কাজ করে প্রতি ৬-৭ মিনিট পরপর। ক্রিকেট ম্যাচে ব্যাটসম্যান ভুল শট খেলে আউট হলে ধারাভাষ্যকারেরা প্রায়ই বলেন, ‘মনঃসংযোগে চিড় ধরায় ভুল শটটি খেললেন অমুক…’। ঠিক একইভাবে চেতনে-অবচেতনে প্রযুক্তিতে ডুবে থাকা অসংখ্য তরুণ প্রতিদিন অনেক কাজেই ‘ভুল শট’ খেলছেন। আবার প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে থাকাও এখন অসম্ভব বোকামি। এমনটাই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন, ‘প্রযুক্তির অপব্যবহার না করলে কোনো সমস্যা নেই। আসক্তি হয়ে গেলেই সমস্যা। তাই সহজ সমাধান হলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় ফোন, ইন্টারনেট দূরে রাখা। অন থাকলেই নোটিফিকেশন আসবে, মনোযোগে চিড় ধরবে।’
মনোযোগ বাড়াতে হলে
মনোযোগ বাড়ানোর এই পরামর্শগুলো দেওয়া হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা ও গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য ঘেঁটে:
* একসঙ্গে একাধিক কাজ নয়: গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের সময় ফেসবুক, ই–মেইল বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার বন্ধ রাখুন। আমাদের মস্তিষ্ক একসঙ্গে একাধিক কাজ করার জন্য তৈরি হয়নি।
* শারীরিক পরিশ্রম: ব্যায়াম, হাঁটাচলা বা দৌড়ঝাঁপ শরীরের জন্য ভালো, এটা আপনি জানেন। তবে এটাও মনে রাখুন, মস্তিষ্কও আপনার শরীরের অংশ। ফলে শারীরিক পরিশ্রম মস্তিষ্ক সুস্থ রাখার জন্যও জরুরি।
* ধ্যান (মেডিটেশন) করুন: মনোযোগ বাড়াতে খুব ভালো ফল দেয়।
* প্রকৃতির কাছে যান: সবুজ একটা বৃক্ষ দেখলেও মস্তিষ্কে ইতিবাচক বার্তা যায়। এমনকি প্রকৃতির ছবি দেখলেও কাজে দেয়।
* বিরতি নিন: একটানা কোনো কাজ করতে করতে বিরক্তি এসে গেলে বিরতি নিন। একটু ঘুরে আসুন, গান শুনুন, আড্ডা দিন।
* সহজ দিয়ে শুরু: যেকোনো কাজের বেলায়, বিশেষ করে পড়াশোনার সময় সহজ বিষয় দিয়ে শুরু করুন। একটা গতি চলে এলে কঠিন বিষয়েও মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়ে যাবে।
* পরিমিত ঘুমান: কম ঘুম আমাদের মনোযোগে বিরাট অন্তরায়। আবার বেশি ঘুমও বড় ক্ষতি করে ফেলে। তাই পর্যাপ্ত ঘুম এবং ঘুমের জন্য শারীরিক শ্রম জরুরি।
* লিখে রাখুন: কোনো কিছু শোনার সঙ্গে সঙ্গে বা পড়ার পর লিখে ফেললে মনোযোগ অন্য কিছুতে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
* মন দিয়ে শুনুন: কেউ কথা বলার সময় মন দিয়ে শুনুন। মাঝখানে কিছু বলতে গেলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
* ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার বাইরে: ইন্টারনেট ব্যবহারের নির্দিষ্ট কিছু সময় ঠিক করে নিন। এটা এক দিনে হবে না, অভ্যাস করুন একটু একটু করে।