বিলেতে মডেলিং আর অভিনয়ে নাম কুড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। সে বন্ধুর পথেই হাঁটছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ রমজান মিয়া। সম্প্রতি লন্ডন ফ্যাশন উইকের জমকালো আয়োজনে মডেল হয়ে র্যাম্পে হাঁটলেন রমজান। তাঁর নাম এসেছে প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ ব্রিটিশ বাংলাদেশির তালিকাতেও। অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে। তরুণ রমজানের এগিয়ে চলার কথা নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
‘লন্ডন ফ্যাশন উইকে প্রথম বাংলাদেশি পুরুষ মডেল’—যুক্তরাজ্যের আঞ্চলিক পত্রিকা নরউইচ ইভিনিং নিউজ-এরএই শিরোনামই উৎসাহ জোগাল খবরটি পড়তে। সান্ধ্য দৈনিকটির খবরে বলা হয়েছে, এই মডেলের নাম রমজান মিয়া। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক রমজান মডেলিং ও অভিনয়গুণে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। কাজের ধারাবাহিকতায় সুযোগ পেয়েছেন লন্ডন ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়ার।
রমজান মিয়াকে পাওয়া গেল ফেসবুকে। মেসেঞ্জারে পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তার উত্তর দিলেন দুই দিন পর। জানালেন, ১৪ সেপ্টেম্বর লন্ডন ফ্যাশন উইকের প্রথম দিনই মঞ্চে হেঁটেছেন তিনি। ব্যস্ততার জন্য মেসেঞ্জারে কথা বলার সুযোগ তেমন হলো না। তিনিই বললেন সাক্ষাৎকারের জন্য প্রশ্ন পাঠাতে। প্রশ্ন-উত্তরেই জানা হলো ২৫ বছরের রমজান মিয়ার এগিয়ে চলার গল্প।
ঝলমলে মঞ্চে
জীবনে বেশি আনন্দিত হওয়ার মতো ঘটনা হরহামেশা আসে না। রমজানের জীবনেও এমন আনন্দের দিন হয়তো হাতে গোনা! তাই লন্ডন ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়ার আনন্দকে এগিয়ে রাখলেন সে তালিকায়। বলছিলেন, ‘যুক্তরাজ্যের প্রোফাইল মডেল ম্যানেজমেন্টের হয়ে আমি সেখানে অংশগ্রহণ করি। র্যাম্পে হাঁটা সব সময়ই আনন্দের ব্যাপার—এমন বড় পরিসরে অংশ নেওয়া তো স্বপ্নের মতো।’
পোশাক প্রদর্শন ও হাল ফ্যাশনের গতি-প্রকৃতির উপস্থাপন থাকে ফ্যাশন সপ্তাহে। বিশ্বের চারটি বড় ফ্যাশন উইকের মধ্যে লন্ডন ফ্যাশন উইক একটি। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন ফ্যাশন উইক। এবার ছিল ৬৮তম আসর। ১৪ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বরের আয়োজনে নামীদামি ১০০টি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তাদের ফ্যাশনপণ্য প্রদর্শন করেছে, ক্যাটওয়াকে হাজির হয়েছেন ৮০ জন ডিজাইনার, অনুষ্ঠান দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন ৫০টি দেশের অতিথি ও পোশাক ব্যবসায়ী।
বাবার নাটকে হাতেখড়ি
রমজানের বাবা কুদ্দুস মিয়ার ছিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। তিনি বাংলাদেশি তারকাদের নিয়ে নাটক, গানের ভিডিও তৈরি করতেন। ১৯৯৮-৯৯ সালের কথা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় লন্ডনে একটি নাটক নির্মাণ করলেন কুদ্দুস মিয়া। তবুও ভালো আছি নামের সে নাটকে একজন প্রবাসীর জীবনকাহিনি তুলে ধরা হলো। সেই নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করলেন রমজান মিয়া। সেই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো। রমজান বলছিলেন, ‘আব্বা চাইতেন আমি অভিনয় করি। দিনে দিনে আমারও আগ্রহ তৈরি হলো। একসময় তো পড়াশোনাও করলাম এ বিষয়েই।’
অভিনয়ে অন্তঃপ্রাণ
রমজান ব্যবসায় ও বিপণন বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়তে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারে। স্কুলের নাটকের দলে থাকতে অভিনয়ের যে পোকা মাথায় ঢুকেছিল, তা নতুন মাত্রা পায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। ইতি টানেন পড়াশোনার। লন্ডনে পাড়ি জমান। ভর্তি হন বার্ড কলেজ অব ড্যান্স অ্যান্ড থিয়েটারে। এখান থেকেই ২০১৬ সালে তিনি কোর্স সম্পন্ন করেন। রমজান বলছিলেন, ‘আমাদের সমাজে অভিনয় বা মডেলিংয়ে পেশা গড়ার কথা ভাবা খুব সহজ ব্যাপার নয়। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয়। আমি যখন প্রতিনিয়ত মানুষের বাহবা পাচ্ছিলাম, তখনই সিদ্ধান্ত নিই ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার।’
এরই মধ্যে লুটন শহরে শুরু হয় স্থানীয় এক ফ্যাশন শোর জন্য মডেল খোঁজার আয়োজন। সে প্রতিযোগিতায় নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন রমজান। যোগাযোগ হয় মডেল ও অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
নিতান্তই শখের বশে মডেলিং আগেও করেছেন। তবে জি-স্টার রো নামে একটি ডাচ পোশাক প্রতিষ্ঠানের মডেল হিসেবে পেশাদার মডেলের কাজ শুরু রমজানের। তিনি বলেন, ‘সে সময় ওদের পোশাক পরে একটি ফ্যাশন শোতে অংশ নিয়েছিলাম। খুব নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু এত বেশি মহড়া করেছিলাম যে ভাবতে ভাবতেই উতরে গিয়েছিলাম।’
এরপরই একে একে সুযোগ আসে কাজের। ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার পল স্মিথ, খেলার সরঞ্জাম তৈরির প্রতিষ্ঠান জেডি স্পোর্টস, অ্যাডিডাস, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, ফরাসি প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ল’ওরিয়েলের মতো প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মডেল হয়েছেন। এখন তিনি কাজ করেন যুক্তরাজ্যে মডেল ও অভিনয়শিল্পী সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিজ বা বিএমএ মডেলস এবং সান্দ্রা রেনোল্ডসের সঙ্গে।
ভূতের গল্প এবং অন্যান্য
রমজানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র গোস্ট স্টোরিজ। লিগেসি, নাকাসহ বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যখন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্নে বিভোর; সেই ২০১৬ সালেই চুক্তিবদ্ধ হন ব্রিটিশ ভৌতিক চলচ্চিত্র গোস্ট স্টোরিজ-এ। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে এ বছরের এপ্রিলে। অ্যান্ডি নাইম্যান ও জেরেমি ডায়সনের পরিচালনায় ওই চলচ্চিত্রে এসথার গুডম্যান নামের এক নারীর প্রেমিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন রমজান। রমজান বলছিলেন, ‘এমন একটি ভৌতিক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল।’
এরই মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনির একটি চলচ্চিত্রে কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন রমজান। আলাদিন নামে এই চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন ব্রিটিশ নির্মাতা গুই রিচি। সিনেমায় রমজানকে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেখা যাবে। এটি আগামী বছর মুক্তি পাবে।
অনুপ্রেরণাদায়ী তরুণ
উদ্ভাবন, নেতৃত্বসহ নিজের অনুকরণীয় কাজের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারকারী ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নিয়েএকটি প্রকাশনা ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইনসপিরেশন ১০০ (বিবিপিআই)’। ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর এই তালিকা প্রকাশ করছে এটি। সেই প্রকাশনায় ২০১৮ সালের ১০০ জন প্রভাব বিস্তারকারীর তালিকায় রয়েছেন রমজান মিয়া। এই তালিকায় এ বছর বর্ষসেরা ব্যক্তি হয়েছেন যুক্তরাজ্যের রানির সর্বোচ্চ সম্মানজনক ‘নাইট’ উপাধি পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিচারপতি আখলাকুর রহমান চৌধুরী।
হৃদয়ে বাংলাদেশ
রমজানের জন্ম ১৯৯৩ সালে, যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের লুটন শহরে। সিলেট সদর উপজেলায় তাঁর দাদার বাড়ি। মাঝেমধ্যেই পা পড়ে সিলেটের মাটিতে—আগামী ১ অক্টোবর দেশে আসছেন সেই ধারাবাহিকতায়। তাই হয়তো ব্রিটিশ বাংলাদেশি হয়েও নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন রমজান। তিনি বলছিলেন, ‘নিজের শিকড় সম্পর্কে না জেনে, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ না করে বেশি দূর এগোনো যায় না। আমি যতটুকু এসেছি, তা সেই শক্তিবলেই।’