কী পড়ছি

মগজের নিয়মকানুন

ব্রেন রুলস
ব্রেন রুলস

কয়েক প্রজন্ম আগের মানুষের কথা ভাবুন। তাঁরা কেউ কি নয়টা-পাঁচটা অফিস করতেন? হাজার বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্ক কখনো এক জায়গায় বসে কাজ করেনি। ক্লাসরুমে বসে টানা ছয় ঘণ্টা বক্তৃতা শোনেনি। এখন আমরা সেটাই করছি। এতে কি আমাদের মস্তিষ্ক বেশি কর্মক্ষম হচ্ছে? নাকি আমরা ভুল পথে আছি? এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন জন মেডিনা। তিনি একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট। খটমট বৈজ্ঞানিক জার্নাল থেকে সাধারণের জন্য তুলে এনেছেন মস্তিষ্কের কর্মপদ্ধতি, নাম দিয়েছেন ব্রেন রুলস। তাঁর হিসাবে, আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে এক ডজন নিয়ম মেনে। নিয়মগুলো জানা থাকলে আপনি বুঝবেন, আপনার মস্তিষ্ককে ভালোভাবে কাজে লাগাতে কোন দিকে জোর দিতে হবে। জন মেডিনার লেখা ১২টি নিয়ম এখানে থাকছে সংক্ষিপ্ত রূপে। আরেকটু বিস্তারিত জানতে পারেন লেখকের ওয়েবসাইট brainrules.net থেকে।

১. শরীরচর্চা

মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তন হয়েছে শারীরিক কাজের মাধ্যমে। হাজার বছর মানুষ প্রচুর হেঁটেছে, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ কিলোমিটার, উত্তরা থেকে শাহবাগের সমান। এভাবে গড়ে ওঠা মস্তিষ্ক চুপচাপ বসে কাজে অভ্যস্ত নয়। তাই কর্মক্ষম হতে হলে আপনাকে শরীরচর্চা করতে হবে। সম্ভব হলে হাঁটতে হবে, দৌড়াতে হবে। কারণ, শরীরচর্চা করলে মস্তিষ্ক বেশি অক্সিজেন পায়, যা তাকে কর্মক্ষম রাখে। শরীরচর্চা নতুন নিউরন কোষ তৈরি করে, মানসিক চাপের কারণে যে ক্ষতি হয়, তা প্রতিহত করে।

২. টিকে থাকা

মানুষের মস্তিষ্কের একটি অংশকে বলে করটেক্স। এই করটেক্সই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা শিখেছি, কীভাবে সমস্যা সমাধান করে বেঁচে থাকতে হয়। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, যোগাযোগ, সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে মানুষের মস্তিষ্ক। তাই পরস্পর সহযোগী হলেই মস্তিষ্ক ভালো কাজ করে, সেটা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে হোক বা অফিসের সহকর্মী।

৩. গঠন

প্রতিটি মস্তিষ্ক আলাদা। ৭৫০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে ভিন্ন রকম ৭৫০ কোটি মস্তিষ্ক আছে, কারও সঙ্গে কারওটা মেলে না। আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড মস্তিষ্কের গঠন, নিউরনগুলোর সংযোগ একটু একটু করে পরিবর্তন করে দেয়, তাই প্রত্যেক মানুষের নিউরনের সংযোগ ভিন্ন। এর অর্থ হলো প্রত্যেক মানুষ ভিন্নভাবে সক্ষম। সবার দক্ষতা ও চিন্তা একই রকম হবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এ ব্যাপার আমলে নেয় না বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

৪. মনোযোগ

মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই একাধিক বিষয় একসঙ্গে করতে পারে না। গভীর মনোযোগে গান শোনা ও পড়া মস্তিষ্কের কাজ নয়। এক সময়ে মস্তিষ্ক শুধু একটি বিষয়েই মনোযোগ দিতে পারে। আরেকটি ব্যাপার হলো মস্তিষ্ক কোনো এক বিষয়ে মাত্র ১০ মিনিট মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। তাই বক্তৃতা দিলে, ক্লাস নিলে বা মিটিং করলে প্রতি ১০ মিনিটে অবশ্যই এমন কিছু করতে হবে, যেন মনোযোগ ফিরে আসে। একঘেয়ে কাজে মস্তিষ্ক সাড়া দেয় কম। কোনো একটি আবেগকে জাগ্রত করে—এমন কিছুর প্রতি মস্তিষ্কের আগ্রহ বেশি।

৫. স্বল্প সময়ের স্মৃতি

মস্তিষ্ক অধিকাংশ বিষয় ভুলে যায়। নতুন কোনো তথ্য পেলে তা বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ায় স্মৃতিতে ধরে রাখে। তবে যে পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে, তার চারটি ধাপ: মস্তিষ্কের ভাষায় এনকোড করে, সংরক্ষণ করে, পুনরুদ্ধার করে, এরপর ভুলে যায়। মস্তিষ্ক কোনো কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখবে কি না, তা তথ্য পাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঠিক করে ফেলে। সাধারণত আর মনে রাখে না। তবে মনে রাখার সম্ভাবনা বাড়ানোর বুদ্ধি হলো একই পরিবেশে একই তথ্য যদি মস্তিষ্ককে আবারও দেওয়া যায়। যেমন একজন সহকর্মীকে যদি আপনি কয়েক দিন আপনার অফিসে দেখেন, আপনার মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময়ের জন্য মনে রাখবে, কিন্তু একজন অতিথি মাত্র একবার এসে চলে গেলে মস্তিষ্ক ভুলে যাবে।

৬. দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি

সাধারণত প্রতিদিন পাওয়া তথ্য মস্তিষ্ক কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুলে যায়। মস্তিষ্ক একই তথ্য নতুন করে পেলে আগের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে একধরনের গড়পড়তা তথ্য সংরক্ষণ করে। কিন্তু একে স্থায়ী করার উপায় হলো তথ্যটা একসঙ্গে না নিয়ে ধাপে ধাপে নেওয়া এবং বিরতি দিয়ে কিছুদিন পরে আবারও একই কাজ করা।

৭. ঘুম

কর্মক্ষম মস্তিষ্কের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অবশ্যই লাগবে। ঘুম কম হলে মস্তিষ্কের প্রতিটি কাজেই ব্যাঘাত ঘটে। এমনিতে মস্তিষ্কের যেসব কোষ ও অণু আপনাকে ঘুম পাড়াতে চায়, সেগুলোর সঙ্গে ঘুম ঠেকানোর কোষ আর অণুর সব সময় টানাটানি চলতে থাকে। কার কতটুকু ঘুম দরকার, তা মানুষভেদে আলাদা। কিন্তু মস্তিষ্ককে সবচেয়ে ভালো কার্যকর রাখতে দুপুরের পর অল্প একটু ঘুমিয়ে নেওয়া সবার জন্য বেশ কার্যকর।

৮. মানসিক চাপ

মানুষের মস্তিষ্ক অল্প সময়ের মানসিক চাপে খুব ভালো কাজ করে। যেমন হুট করে আপনার পাশ দিয়ে গর্জন দিয়ে একটা বাঘ চলে গেলে তখন আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু লম্বা সময় ধরে এমন চাপ চলতে থাকলে আপনার মস্তিষ্ক কাজ করে না। প্রমাণ পাওয়া গেছে, দীর্ঘ সময়ের মানসিক চাপে মস্তিষ্ক শুধু সাময়িক কর্মক্ষমতা হারায় না, বরং ডিপ্রেশনের মতো অসুস্থতাও তৈরি করে।

৯. ইন্দ্রিয় অনুভূতি

মস্তিষ্ক সবচেয়ে ভালো কাজ করে, যখন কোনো ঘটনায় অনেক অনুভূতি কাজ করে। যেমন একটা বিষয় পড়ার সময় জোরে পড়লে কান শুনতে পায়, তাহলে দেখা আর শোনার অনুভূতি হয়, এরপর আবার লিখলে আরও নতুন অনুভূতি যুক্ত হয়। দেখা গেছে ঘ্রাণের অনুভূতি থাকলে মস্তিষ্ক সাড়া দেয় বেশি।

১০. দৃষ্টির অনুভূতি

সব অনুভূতির মধ্যে দৃষ্টিশক্তি সবচেয়ে বেশি মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করে, প্রায় অর্ধেক মস্তিষ্ক সক্রিয় হয় দেখার মাধ্যমে। তবে বাস্তবে কোনো কিছু যেভাবে আছে, মস্তিষ্ক ঠিক সেভাবেই দেখে না অনেক সময়, বরং নিজের মতো করে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে নেয়। পড়া বা শোনার চেয়ে দেখার মাধ্যমেই আমরা শিখি সবচেয়ে বেশি।

১১. লিঙ্গ

পুরুষ আর নারীর মস্তিষ্কে অনেক পার্থক্য আছে। এর উৎস এক্স ক্রোমোজম। মেয়েদের ডিএনএতে একজোড়া এক্স ক্রোমোজম আছে, যা মা ও বাবার এক্স ক্রোমোজমের মিশ্রণে তৈরি। পুরুষের এক্স ক্রোমোজম একটা, যা শুধু মায়ের থেকে আসে। বিপরীতে যে ওয়াই ক্রোমোজম আছে, তার জিনের সংখ্যা মাত্র ১০০, যেখানে এক্স ক্রোমোজোমের জিন ১ হাজার ৫০০টি। এক্স ক্রোমোজমের অনেক জিন মানুষের মস্তিষ্কের গঠনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু মস্তিষ্কের এই পার্থক্যের তাৎপর্য বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না।

১২. অনুসন্ধিৎসু

মস্তিষ্ক সব সময় অনুসন্ধিৎসু, আবিষ্কার করতে চায়। শিশুদের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। শিশুরা শুধু পরিবেশের দিকে তাকিয়ে দেখে দেখে শেখে না, বরং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে চায়। এসব কর্মকাণ্ড থেকে মস্তিষ্ক কাজগুলো সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করে, পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তা কাজে লাগায়। এ জন্য ছোটবেলায় আগুনে হাত দেওয়ার শখ হলেও বড় হয়ে কেউ আগুনে হাত দেয় না।

এখানে খুব সংক্ষেপে মস্তিষ্কের কর্মপদ্ধতির ১২টি নিয়ম লেখা হলো। মস্তিষ্ককে আরও কার্যকর করতে এগুলো মনে রাখতে পারেন। তবে সরাসরি যেগুলো আপনার মস্তিষ্ককে আরও কার্যকর করবে, যেমন: শরীরচর্চা, ঘুমানো, সমস্যা সমাধানের অভ্যাস, সেগুলো চর্চা করতে পারেন নিয়মিত।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং