পুলিশের কাজটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও আমি বলব জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে পুলিশের যে বিভাগ, সেটির ঝুঁকির ধরন আলাদা। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) সব সময় জঙ্গিদের খোঁজখবর করে, গতিবিধি নজরে রাখে। জঙ্গিরাও কিন্তু সিটিটিসির পুলিশ সদস্যদের একইভাবে অনুসরণ করে। কাজের ক্ষেত্রে সিটিটিসিকে বেছে নেওয়াই একটা সাহসের কাজ। মাহফুজা লিজার সে সাহস আছে পুরো মাত্রায়। কাজ দেখে ভয় পাওয়ার মানুষই নন মাহফুজা। তিনি এখন সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার।
আমি কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার হিসেবে কর্মরত আছি। সিটিটিসি পুলিশের একটি নতুন শাখা। ২০১৬ সালে এর শুরু। মাহফুজা আমাদের সঙ্গে আছেন দুই বছর ধরে। তবে তাঁকে আমি আরও আগে থেকে জানি, সেই ২০১২ সাল থেকে। সেই সময় মাহফুজা পুলিশ সদর দপ্তরে কাজ করছিলেন। তবে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য তিনি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। এ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ বছর পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএমও পেয়েছেন।
মাহফুজা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকোয়ারি ইউনিভার্সিটি থেকে ‘সাইবার সিকিউরিটি পুলিশিং, ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। রাজশাহী পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ইন পুলিশ সায়েন্স সম্পন্ন করেন। প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। মাহফুজা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, ইন্টারপোলসহ দেশ–বিদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছেন। হাইতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে নারী কন্টিনজেন্টের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। সেখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, ইউনাইটেড নেশনস পিস মেডেল পেয়েছেন। তাঁর বেশ কিছু প্রকাশনাও আছে।
সিটিটিসিতে অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে মাহফুজা যে কাজ করেন, তা হলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ। সিটিটিসিতে বিচার–বিশ্লেষণের কাজটা জরুরি। তিনি আসামি জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তরুণ ও যুবকদের মধ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এককথায় বলতে গেলে মাহফুজা আমাদের কাছে তথ্যব্যাংকের মতো।
আমি এই ফাঁকে আরেকটা কথা বলে রাখতে চাই। পুলিশে আমি যেসব নারী কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের সবাই আমার চোখে দুর্দান্ত, আমি জানি অন্যরাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। চাকরিজীবনের শুরুতে রাজারবাগে আমি পেয়েছিলাম শামসুন্নাহার স্যারকে। এখন তিনি গাজীপুরের পুলিশ সুপার। এরপর পেয়েছি জেসমিন স্যারকে। তিনিও ছিলেন খুবই দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। সুনন্দা স্যারের কথাও বলব। মাহফুজা আসলে এই ধারাবাহিকতাই বজায় রেখে চলেছেন।
মাহফুজার যে বিষয়টা প্রশংসনীয়, তা হলো তাঁর উপস্থাপন কৌশল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। দেশের ভেতর বা আন্তর্জাতিক যেকোনো অনুষ্ঠানে সিটিটিসিকে উপস্থাপনের দায়িত্বটা তিনিই এখন পালন করছেন। লেখেনও চমৎকার।
জঙ্গিবাদ দমনের কাজে মাহফুজা লিজা অবদান রাখবেন, এটাই আমার বিশ্বাস। তিনি জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত ৮৫ জন নারীর জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করে নারীদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে রাখতে কী করতে হবে, তা-ও পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর কাজের একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে।
নারী সহকর্মীদের সম্পর্কে অনেকেই একটা প্রথাগত ধ্যানধারণা নিয়ে বসে থাকেন। যেমন নারীরা কাজের চেয়েও সংসার-সন্তানে মন দেন বেশি ইত্যাদি। আমি আমার চাকরিজীবনে এমনটা পাইনি। মাহফুজা লিজাও তার ব্যতিক্রম নন। ধরুন, আপনার সন্তান অসুস্থ, কিংবা মা–বাবা। হয়তো পরিবারে খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে। পুরুষ কর্মকর্তারাও সেদিকে নজর দেন, দেওয়াই উচিত। কিন্তু প্রায়ই নারী কর্মকর্তাদের নামটা অভ্যাসবশত অনেকে বলে ফেলেন। এটা ঠিক নয়। মাহফুজা লিজা পুরোদমে পেশাদার কর্মকর্তা। বললাম তো, তিনি কাজ দেখে ভয় পাওয়ার মতো মেয়েই নন।
লেখক: উপকমিশনার, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, বাংলাদেশ পুলিশ