সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত একটি যুগান্তকারী ছবির নাম ‘হারানো সুর’। এই ছবি আদ্যোপান্ত না দেখলে ‘সুর হারানো’ বিষয়টা মানুষের জীবনে কতটা প্রকট ও রহস্যময় হয়ে উঠতে পারে, তা হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। তবে এই রচনায় ‘সুর’ প্রাসঙ্গিক, মূল আলোচনা ‘ভুল করা’ নিয়ে। অভিনয়ে সুচিত্রা সেন ছিলেন মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসক ডক্টর ব্যানার্জির ভূমিকায়। একজন মানসিক রোগীর ভুল চিকিৎসায় হাসপাতালের একজন উপরস্থ ডাক্তারের ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়লেন তিনি। সিনিয়র ডাক্তার তা বুঝতে পেরে তাকে অপমান করলেন। তার আক্রমণাত্মক কথায় ভীষণ বিরক্ত হয়ে যখন দুষ্প্রাপ্য চাকরির পদ থেকে রিজাইন দিতে চাইলেন তিনি, তখন কর্মাধ্যক্ষ বললেন,
‘আপনি ভুল করছেন ডক্টর ব্যানার্জি।’
মর্মাহত সুচিত্রা সেন অকুণ্ঠ প্রগল্ভতার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ‘আমার বাবা বলেন, ভুল করার অধিকারটা মানুষের মস্ত একটা পারসোনাল অধিকার।’
ভুল করার অধিকার মানুষের আছে বৈকি! কিন্তু এই ভুলটা যখন অন্য কেউ ‘ভুল’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন মানুষের আত্মমর্যাদায় লাগে, মানতে কষ্ট হয়। এদেশীয় মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করতে পারঙ্গম নয়, এমন নয়। কিন্তু অন্য কেউ এটা ধরিয়ে দিলে তা তাকে ভীষণভাবে আহত করে। পশ্চিম বিশ্বের মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মতো নয়। তারা সাধারণত সরলভাবেই ভুল স্বীকার করে। ভুল আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই কালবিলম্ব না করে বলার চেষ্টা করে, ‘ইট ওয়াজ মাই মিস্টেক, আই এম সরি ফর দ্যাট।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর করা সুজাতা চ্যাটার্জির গাওয়া জনপ্রিয় একটি গানের লিরিক হলো—
‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল।’ এই ভুল স্বগতভাবে নিজের জীবনের ভুল বা ব্যর্থতার কথা বলছে, অন্যের জীবনের ভুলের কথা নয়। একটি ত্রিপর্ণ কবিতার দুটি চরণ হলো—
‘ভুল করে তুই ভাঙলি মৎস্যাধার
মাছের সাথে কি ভুল বোঝাবুঝি ছিল?’
প্রাকৃতিক জলাশয়ে ঘুরেফিরে স্বাধীন জীবন যাপন করত সুন্দর ঝিলমিলে এক গোল্ডফিশ। সেখান থেকে তুলে এনে দৃষ্টিনন্দন সেই মাছকে অ্যাকুয়ারিয়ামের ক্ষুদ্র চৌহদ্দিতে বন্দী করা হয়েছে। কবিতাটি সিম্বলিক, গোল্ডফিশ এখানে এক নারীর প্রতীক। তার জীবনটা এমনিতেই ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ, এরপরও তার জীবনকে নস্যাৎ করার অধিকার আমাদের কতটুকু? তবু আমরা অধিকার ফলিয়ে বলতে পারি না, ভুল করে তুই কেন বউ তাড়িয়ে দিলি! কারণ, ভুল করা মানুষের পারসোনাল রাইট, ব্যক্তিগত অধিকার।
প্রতিটি ভুল আমাদের শিক্ষা দেয়, জীবনের নানা দিক সম্পর্কে অভিজ্ঞতা দান করে। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা আর কিছু নয়, ভুলেরই নামান্তর। আইনস্টাইনও বলেছেন প্রায় অনুরূপ কথা, ‘ভুল না করার একটি নিশ্চিত উপায় হলো নতুন কিছু ধারণা করা।’ যে কাজ করে, তারই ভুল হয়। যে কর্মকুণ্ঠ, তার ভুল হওয়ার আশঙ্কা কোথায়! আমরা ভাবতে পারি, ভুল বলে কিছু নেই, সবই শিক্ষা।
ফেসবুক, টুইটার কিংবা মেসেঞ্জার–জাতীয় সামাজিক মিডিয়াগুলোয় প্রচুর মন্তব্য ও কথোপকথন হয়। কেউ একজন ভুল করলে আরেকজন তার চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। হরহামেশাই বলতে শুনি বা লিখতে দেখি এ–জাতীয় কথা—
‘আপনি ভুল বলছেন, এটা কখনো সূর্যমুখী নয়, সিঙ্গাপুর ডেইজি।’ অথবা ‘না, ঠিক হলো না, এটা সিঙ্গাপুর ডেইজি।’
এখানে উভয় ক্ষেত্রে সরলভাবে মন্তব্যে বলা যেত ‘এটা সিঙ্গাপুর ডেইজি।’ ‘আপনি ভুল করছেন’ বা ‘না, এটা ঠিক নয়’, এ ধরনের আহতকর প্রারম্ভিক কথা সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। আরেকজনের ভুলকে প্রতিষ্ঠা করে নিজের শুদ্ধি প্রচার করা এক অসহ্য অমানবিক ব্যাপার। মূলত, এই আক্রমণাত্মক কিংবা নঞর্থক বাক্য উচ্চারণের মধ্যে রয়েছে একধরনের সুখ, অবাঞ্ছিত আত্মপ্রসাদ। বাক্য বিস্তার করে ভাব সম্প্রসারণ করলে মন্তব্যের অর্থ দাঁড়াতে পারে, ‘আপনি একটা গো-মূর্খ, এই সাধারণ বিষয়েও আপনার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, আমি আপনার চেয়ে ঢের বেশি জানি এবং সঠিক জানি, এখন আমার কাছ থেকে শিখে নিন, এর নাম সিঙ্গাপুর ডেইজি।’
সত্যিকার হলেও নাপিতকে নাপিত বলা যায় না, ভুলকেও ভুল বলে উল্লেখ না করলেও চলে। আমি এমনও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিকে জানি, যিনি জীবনে ‘ভুল’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। অন্য কথা দিয়ে বুঝিয়ে বলেছেন ভুলের বিষয়টি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমার এক বিখ্যাত কবিবন্ধুর কথা। তিনি কবিতায় প্রেম, প্রণয়, ভালোবাসা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন না, একান্ত অপরিহার্য না হলে। কাব্য রচনায় তাঁর একটি ধারণার কথা জানালেন আমাকে, ‘ছেলেটি মেয়েটিকে ভালোবাসে’, এ কথা বলামাত্র উপসংহার চলে আসে, প্রেমের গল্প-কবিতা যেন শেষ হয়ে যায়। বরং সংলাপে, চিত্রকল্পে পরিবেশ নির্মাণ করতে হয় যাতে আপনা থেকে এই ভালোবাসাটুকু পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়।
‘ভুল’ শব্দটিকে আমি কারও জীবন-অভিধান থেকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করার পরামর্শ দিতে পারি না, ওপরে উল্লিখিত শ্রদ্ধাভাজন মানুষটির মতো। অপারগতায়, অপরিহার্য মনে হলে কৌশলে তা ব্যবহার করা যেতেই পারে। এই শব্দ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন, হৃদয়ের মমত্ববোধকে জাগ্রত রাখা, অন্যের ভালো লাগাকে মূল্যায়ন করা। একজন মানুষকে, পরিচিত অপরিচিত যেকাউকে, ফুল-পাখি-প্রাণীকে, এমনকি জড়বস্তুকেও আহত করার অধিকার আমাদের কতটুকু!
লেখক: কিউরেটর (টেক), সায়েন্স ওয়েসিস জাদুঘর, রিয়াদ, সৌদি আরব।