>চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সমাজবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক...জীবনে যা-ই হতে চাও না কেন, ভালো লেখার গুণ তোমাকে এগিয়ে রাখবে। লিখেছেন আনিসুল হক
ভালো করে কথা বলা, আর সুন্দরভাবে লিখতে পারা—এই দুটো জিনিস সারা জীবনই কাজে লাগে। ‘কাকের কঠোর রব বিষ লাগে কানে। কোকিল অখিল–প্রিয় সুমধুর গানে।’ কোকিল সুন্দর করে গান গায় বলেই তার এত সুনাম।
সুন্দরভাবে বলা আর সুন্দরভাবে লেখা, তা দিয়ে কিন্তু জগৎ জয় করা যায়। লেখার কাজ কেবল লেখক করবেন, তা নয়, সারা জীবনেই আমাদের অনেককে লিখতে হবে। ধরা যাক, বিজ্ঞানী সত্যেন বোস। তিনি তাঁর প্রবন্ধ আর চিঠি ঢাকা থেকে পাঠিয়েছিলেন জার্মানিতে, আইনস্টাইনের কাছে। আইনস্টাইন সেই পেপার পড়ে মুগ্ধ হয়ে নিজে ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্নালে দিয়েছিলেন ছাপাতে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক—যা-ই হতে চাও না কেন, জীবনে যদি তুমি ভালো করতে চাও, তোমাকে ভালো লিখতে পারতে হবে।
তোমাকে ভালো লিখতে হবে পরীক্ষার খাতায়। তোমাকে ভালো লিখতে হবে থিসিস পেপার বা রিপোর্ট। জার্নালে তোমাকে ভালো লিখতে হবে। যাঁরা গবেষণা করেন, সেই গবেষণার তহবিল জোগাড় করার জন্য তাঁদের বড় বড় প্রস্তাবনা লিখতে হয়। মানে আজকের দুনিয়ায় কেউ যদি বড় হয়, লেখালেখির কাজটা তাকে আজীবন করে যেতে হবে।
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না, প্রথমত যেটা লাগে তা হলো, একটা বা দুটো ৪০০ / ৫০০ শব্দের রচনা লেখা। কেন তুমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাও, এখানে পড়ে তুমি সমাজে কী ভূমিকা রাখবে, এই ধরনের কোনো রচনা। ওই রচনা যে ভালো লেখে, সে-ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়।
পৃথিবীতে যাঁরা বড় প্রভাব রেখে গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু লিখেছেন। যেমন ধরো, আমরা কার্ল মার্ক্সের কথা জানি, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কথা জানি, অমর্ত্য সেনের কথা জানি; কারণ তাঁরা লিখেছেন। মানে হচ্ছে, তুমি বিজ্ঞানী হতে পারো, অর্থনীতিবিদ হতে পারো, দার্শনিক হতে পারো, সমাজবিদ হতে পারো, লিখতে তোমাকে হবেই। না লিখে কেউ সমাজে সভ্যতায় প্রভাব রাখতে পারবে না। আলো ছড়াতে পারবে না।
আমরা জওহরলাল নেহরুর লেখা পাঠ করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের লেখা পাঠ করি, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তো নোবেল পুরস্কারই পেয়েছেন লেখক হিসেবে।
কাজেই তোমাকে দুটো গুণ অর্জন করতে হবে, একটা হলো ভালো করে বলতে পারা, আরেকটা হলো ভালো করে লিখতে পারা।
কী করলে ভালো বলতে পারবে? কী করলে ভালো লিখতে পারবে?
প্রথম কাজ হলো, চর্চা। অনুশীলন। তুমি বিতর্ক করবে, বক্তৃতা করবে, আবৃত্তি করবে, নাটক করবে। তাহলে তোমার মঞ্চভীতি দূর হবে। তুমি প্রমিত উচ্চারণ শেখার জন্য রেডিওর খবর শুনবে, টেলিভিশনের খবর শুনবে। আবৃত্তি শুনবে। আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তিও হয়ে যেতে পারো। এরপর তোমাকে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে যেতে হবে। যত বেশি বলবে, তত তোমার জড়তা কাটবে।
ভালো লেখার জন্য কী করবে?
ভালো লেখার জন্য দুটো জিনিস লাগবে। এক. পড়া। দুই. লেখা। তোমাকে প্রচুর বই পড়তে হবে। রোজ বই পড়তে হবে। শুধু পড়ার বই নয়, বাইরের বই। সব ধরনের বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনী, আলোচনা, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস—সব।
আর তোমাকে লিখতে হবে। বাংলাদেশের লেখাপড়ার সিস্টেম বা ব্যবস্থায় একটা ত্রুটি আছে। আমরা ‘রচনা’ মুখস্থ করাই। উন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই ফ্রি রাইটিং করতে দেওয়া হয়। বলা হয়, ছুটির দিনে কী করেছ, লিখে ফেলো। ওই যে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের গাছটা। ওটা নিয়ে লিখে ফেলো। ওরা বানিয়ে বানিয়ে লেখে। প্রথম প্রথম বানানের ভুলও ধরা হয় না। বাক্য ভুল হলেও তা নিয়ে কেউ চোখ তুলে তাকায় না। আগে লেখো। জড়তা কাটুক। পরে ব্যাকরণ নিয়ে মাথাব্যথা করা যাবে। ছোটবেলা থেকে এইভাবে লিখতে লিখতে ওই সব দেশের মানুষেরা প্রত্যেকেই নিজেকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারে। প্রায় সবার লেখারই একটা মান তাই বজায় থাকে।
কিন্তু আমরা নিজেরা বানিয়ে কিছু লিখি না। আজকাল তো টিকচিহ্ন দিয়েই ম্যালা নম্বর পাওয়া যায়। আমাদের লেখার অভ্যাস চলে যাচ্ছে। তা ভালো কথা নয়। এসো, আমরা লিখি। প্রচুর পরিমাণে লিখি। যত লিখবে, লেখা তত ভালো হবে, তত ভালো করবে জীবনে।
পেশাদার সাহিত্যিক হতে হলে কী করবে?
এর বাইরে থাকল সাহিত্যিক হওয়া বা লেখক হওয়ার স্বপ্ন। সে জন্যও প্রচুর পড়তে হবে, প্রচুর লিখতে হবে আর প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। লেখক হতে গেলে আর যা লাগে, তার নাম সাধনা। সাধনা সব ক্ষেত্রেই লাগে। যেমন একজন ক্রিকেটারকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। একজন রাজনীতিবিদকে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। একজন লেখককেও তেমনি নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে হয় লেখালেখির জন্য। তাকে লেগে থাকতে হয়। কচ্ছপের কামড় দিয়ে পড়ে থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে, গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে, দেয় না কিছুই আলো।’ তুমি যদি লেখক হতে চাও, নিজেকে পোড়ানোর জন্য প্রস্তুত থাকো।
কিন্তু সবাই লেখক হবে না। একেকজন একেক পেশায় যাবে। যে পেশাতেই যাও না কেন, ভালো লেখার গুণটা তোমার দরকার পড়বেই। কাজেই এখন থেকেই পড়তে শুরু করো, আর লিখতে শুরু করে দাও।