৫০ বছরের দাম্পত্যজীবনে আবদুল হাই খান ও আয়েশা খানমের যে ঝগড়াঝাঁটি হয়নি, তা নয়। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে কত চড়াই-উতরাই যে পেরোতে হয়েছে। কখনো মনোমালিন্য, আর্থিক কষ্ট, কখনো কর্মসূত্রে দূরে থাকা, পাওয়া না পাওয়ার হিসাবটা অনেক সময়ই মেলেনি। তবে একটা সুতা যেন শক্ত করে গিঁট বেঁধে ছিল সম্পর্কটাতে। তাই এত বছর পার হলেও ঘরভর্তি নাতিনাতনির মধ্যেও আলাদা করে মমতা দেখান দুজন দুজনকে। এখনো প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গাছের সবচেয়ে ডাসা ও পাকা দুটো বরই তুলে এনে ঘুমন্ত স্ত্রীর খাটের পাশে রেখে দেন আবদুল হাই খান—সবার অলক্ষ্যে। একবার দুষ্টু নাতনি দেখে ফেলল ঘটনাটি। ‘নানাভাই আমাদের না দিয়ে নানিকে কেন দিলেন’—জানতে চাইলে একগাল হেসে আবদুল হাই বলেন, ‘ছোট্ট খুকিকে ঘরে এনেছিলাম। পাকা বরই খেতে ভালোবাসত।’
এভাবেই যত্নে রাখতে হয় ভালোবাসাগুলো। ঘরের সবচেয়ে দামি জিনিসটি যেমন যত্নে রাখা হয়, তেমনি মনের সবচেয়ে দামি জিনিস ভালোবাসারও একটু যত্নের প্রয়োজন পড়ে। আসলে সম্পর্ক হচ্ছে গাছের চারার মতো। চারার যেমন যত্ন নিতে হয়, সম্পর্কেরও তেমনি। না হলে গাছের মতো সম্পর্কও মরে যায়। ইংলিশ লেখক টমাস ফুলারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘ভালোবাসতে শেখো, ভালোবাসা দিতে শেখো, তাহলে তোমার জীবনে ভালোবাসার অভাব হবে না।’ অনেকেই বলেন, ‘ব্যস্ত জীবনে পরিবার, সংসার, সন্তান পালন, আয়ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে ভালোবাসা দৌড়ে পালায়। ভালোবাসি বলেই তো সব করি। আলাদা করে ভালোবাসার সময় কই?’ আসলে সারা দিন ভালোবাসি-ভালোবাসি বলার প্রয়োজন পড়ে না, ছোট ছোট কাজ দিয়েই প্রকাশ করা যায় সঙ্গীকে কতটা ভালোবাসি। ছোট ছোট ভালো-মন্দ অনুভূতির গুরুত্ব দেওয়া, প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও অল্প একটু সময় বের করে সঙ্গীর খোঁজ নেওয়া, ছুটির দিন ঘরের সব কাজ শেষে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ছোট্ট করে বিদায় জানানো, বিপদে শুধু চুপ করে পাশে থাকাটাও অনেক কিছু প্রকাশ করে।
একে অপরকে শ্রদ্ধা
সঙ্গীকে শ্রদ্ধা করুন। দুজন মানুষ আলাদা সত্তা, এক করে মেলানো ঠিক নয়। সঙ্গীর মতের সঙ্গে সব সময় আপনার মতের মিল না–ও হতে পারে। প্রেমিক-প্রেমিকা হোক, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু এমনকি মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যেও মতবিনিময়ে অমিল হতে পারে। তাই বলে নিজের মতামত সঙ্গীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। পরামর্শ দিতে পারেন, হয়তো ঠিক মনে হচ্ছে না, সেটাও সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারেন। তবে তিরস্কার করবেন না কখনোই।
রায়হান ও সোমা দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ব্যস্ততার সীমা নেই। আজকাল কেবল সন্তানের দরকার-অদরকার নিয়েই কথা হয় এই দম্পতির মধ্যে। কীভাবে যে দূরত্ব আসছে, নিজেরাও টের পাচ্ছেন না। প্রায়ই কাজের সময় হঠাৎ করে রায়হানকে ফোন দেন সোমা। ব্যস্ত রায়হান বেশির ভাগ সময়ই ফোনটা কেটে দেন। এ ক্ষেত্রে বলতে হয় সঙ্গীর কথা শুনুন। হয়তো সে প্রয়োজনীয় কথা বলছে না, সব সময়ই যে কথা প্রয়োজনেই হবে, এমনটা কিন্তু ভালোবাসার নিয়ম নয়। যে অনুভূতিটি তিনি প্রকাশ করতে চাইছেন, সেটি বোঝার চেষ্টা করুন।
সুন্দর ব্যবহার
সব সম্পর্কেরই ঝগড়াঝাঁটি হয়। এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রায়ই দেখা যায়, রেগে গিয়ে একে অপরকে কঠিন কথা শুনিয়ে ফেলে মানুষ। উল্টোপাল্টা আচরণ করে বসে। এটাই মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। এসব ক্ষেত্রে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে পরে সঙ্গীর ভুলটা বুঝিয়ে ধরিয়ে দেওয়া যায়।
আচরণে কৃত্রিমতা নয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব প্রকাশ করছি ভালোবাসা, একসঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি। অথচ দুজনের সম্পর্কে যোজন যোজন দূরত্ব। মানুষের সামনে হয়তো বলছি সঙ্গীকে ছাড়া চলেই না, অথচ সঙ্গীর সামান্য চাওয়াটাও পূরণ করছি না। বাইরের মানুষের সামনে ভালোবাসার উদাহরণ অথচ ভেতরে একে অপরের আবেগে দিই না মর্যাদা, জীবনে এসব কৃত্রিমতা না থাকাই ভালো।
একান্তে কিছু সময় কাটান
ব্যস্ত জীবনে একে অন্যকে দেওয়ার সময় কোথায় আমাদের। সন্তান, সংসারের জাঁতাকলে জীবন অতিষ্ঠ। তবে এর মধ্যেই প্রিয়জনের জন্য কিছু সময় আলাদা করে বরাদ্দ রাখতে হবে। হতে পারে সকালে দুজন একসঙ্গে কফি খাওয়া। নয়তো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটের আলাপন। সে যে আপনার জীবনের বিশেষ কেউ, এটা সঙ্গীকে বুঝিয়ে দিন। অবসর সময়ে মুঠোফোনে চোখ আটকে না রেখে পাশে থাকা মানুষটার সঙ্গে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলুন। আপনি আছেন সব সময়, এই ভরসাটুকু যেন সঙ্গী আপনার কাছ থেকে পায়।
ঘুরতে যাওয়া যায় বাইরে কোথাও
জীবনে টেনশন থাকে, ক্লান্তি থাকে—সবকিছু নিয়েও পরিবারের সঙ্গে অসাধারণ সময় কাটানো যায়, দায়িত্ব পালন করা যায়, বাচ্চাদের শখ পূরণ করা যায়, আনন্দ করা যায়। ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে আলাদা করে ঘুরতে যাওয়া যায়। এ সবকিছুই যত্নে রাখে সম্পর্ককে।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন
সঙ্গী আপনাকে খুশি করতে কোনো উদ্যোগ নিলে হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানান। বিশেষ কোনো খাবার রান্না করলে, কোনো কিছু উপহার দিলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। তাঁকে ধন্যবাদ জানান। তবে কখনোই সঙ্গীকে কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না। অমুক এটা করে, তমুক তো তোমার মতো না। ও পারে তুমি কেন পারো না বলে সঙ্গীকে দোষারোপ করতে যাবেন না। সব সময়ই সঙ্গীর সহযাত্রী হওয়ার চেষ্টা করুন। শুধু সুখে নয়, দুঃখের দিনেও তাঁর পাশে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে দাঁড়ান।
অলক্ষ্যে বদনাম নয়
সঙ্গীর নেতিবাচক দিকটি অন্যের কাছে তুলে ধরবেন না। হয়তো গল্পে গল্পেই কাউকে বলছেন। তবে সেটা সে জানতে পারলে যে কষ্ট পাবেন, তা সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। সেই সঙ্গে আজ যা বর্তমান, কাল তা–ই অতীত। তাই অতীতের ভুলত্রুটি আঁকড়ে ধরে রাখবেন না। সঙ্গীর অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো। বর্তমানের মানুষটাকে ভালোবাসুন।
শাহেদ ও রিতুর ১০ বছরের সংসার। জানালেন, এই ১০ বছরে ভালোবাসা প্রকাশের জন্য খুব কষ্ট করে কিছু করার প্রয়োজন পড়েনি তাঁদের। এই দম্পতি মনে করেন, দামি উপহার দিয়ে যা হয় না, হয়তো ছোট্ট একটা অনুভূতিই তা প্রকাশ করে দেয়। যেমন যখনই শাহেদ ঘর থেকে বের হন বারান্দায় দাঁড়ান রিতু। শাহেদ বোঝেন, তাই সব সময় পেছন ফিরে তাকান, হাত নেড়ে একটু হাসেন। ছোট এই আদান-প্রদান চমৎকার করে দেয় তাঁদের জীবনটাকে।
ছোট ছোট অনুভূতি প্রকাশ
চমক কে না ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে সঙ্গীকে তাঁর কর্মস্থলে পৌঁছে দিন। অফিস থেকে ফেরার পথে একসঙ্গে ফিরুন, হঠাৎ করে কোনো উপহার আনা, বিশেষ দিনগুলো মনে রেখে আলাদা করে কিছু করা, সঙ্গী যা খেতে ভালোবাসে মনে করে তা মাঝেমধ্যে নিয়ে আসা ছোট ছোট এই চমকগুলোই সম্পর্কটাকে দীর্ঘমেয়াদি করে তুলবে। বাসায় ফিরেছে কি না খোঁজ নেওয়া, অসুস্থ থাকলে শরীর কেমন, অফিসে সমস্যা হচ্ছে কথা বলে মনটা হালকা করে দেওয়া, বৃষ্টির দিনে বাইরে থেকে খাবার কিনে আনা, এসব ছোট ছোট অনুভূতি যত্নে রাখে ভালোবাসাকে। অনেক সময় দেখা যায় সন্তান হওয়ার পর একজন মা আলাদা করে নিজের জন্য সময় বের করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে সন্তানকে নিজের কাছে রেখে, স্ত্রীকে নিজের যত্ন নেওয়ার সময় করে দেওয়াও ভালোবাসা প্রকাশ করে।