১৩ বছর বয়সের স্বচ্ছ (ছদ্মনাম)। একদিন বিকেলে বাসায় ফিরতেই মা দেখলেন তার ঠোঁট কেটে, ফুলে রক্তারক্তি। জিজ্ঞেস করতেই বলল রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর স্বচ্ছর বন্ধু আহনাফের (ছদ্মনাম) মায়ের ফোন। তিনি ফোন করে জানালেন, স্বচ্ছ আর আহনাফ নাকি মারামারি করেছে। আহনাফের মাথা কেটে গেছে, কয়েকটি সেলাইও দিতে হয়েছে!
১৪ বছর বয়সের মেয়ে সাবরিনা (ছদ্মনাম)। একদিন স্কুল থেকে ফোন এল তার বাবার কাছে। এক্ষুনি স্কুলে যেতে হবে তাঁদের। মা–বাবা দুজনেই কাজ ফেলে স্কুলে গিয়ে শুনলেন, তাঁদের মেয়ে স্কুলের ওয়াশরুমে সিগারেট খাচ্ছিল আরও দু–তিনজনের সঙ্গে। ব্যাগ সার্চ করে এক প্যাকেট সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরীরাউদ্দেশ্যমূলকভাবে বা কখনো নিজের অজান্তেই ভুল কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এই সময় তারা জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) আর নৈতিকতার বিকাশের (মর্যাল ডেভেলপমেন্ট) গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো পার হতে থাকে। ফলে যেভাবে জগৎকে চিনতে শেখে আর ভুল-শুদ্ধর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে, তার ধারাবাহিকতা সারা জীবন চলতে থাকে। ফলে এই বয়স তাদের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্ব তৈরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের ভুলগুলো যদি শোধরানো না যায়, তবে ভবিষ্যতে তারা নানা অন্যায় আর অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে।
বেশির ভাগ সময় মা–বাবারা এই ভুলগুলোর জন্য সন্তানকে শারীরিক নির্যাতন করেন (মারধর করেন), মানসিক নির্যাতন করেন (বকা দেন, ব্যঙ্গ করেন) এবং শোধরানোর বদলে আরও বেশি ভুলের মধ্যে ঠেলে দেন। বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরীদের মা–বাবাকে সন্তানের এই ভুলগুলো শুধরাতে কৌশলী হতে হবে, সেই সঙ্গে অন্যান্য অভিভাবক, বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষকদের হতে হবে মানবিক।
কেন ওরা এই ভুলগুলো করে
এই বয়সে সে না ছোট না বড়, তাই সে একধরনের অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে তার এমন কিছু করতে হয়, যা অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। সে দেখে, স্বাভাবিক আচরণ করলে কেউ মনোযোগ দেয় না, কিন্তু ভুলত্রুটি করলে সবাই নেতিবাচকভাবে হলেও তার প্রতি মনোযোগী হয়। কিশোরেরা অনেকটা ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’–এর মতো রেগে থাকে, আগ্রাসী হয়; হিরোইজম দেখানোর জন্য আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। মেয়েরা এ সময় প্রায়ই কপাল কুঁচকে থাকে, কম হাসে, ভাবে, হাসলে তার ব্যক্তিত্বের ঘনত্ব কমে যাবে!
বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরীদের দেহে হরমোনের পরিবর্তন হয়, এই পরিবর্তনের প্রভাবে তার মনে আবেগের ঝড় বয়ে যায়। কখনো বিপরীত লিঙ্গের আরেকজনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়, কিন্তু এই আকর্ষণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তা নিয়ে বাবা-মা বা শিক্ষকেরা পরিষ্কার করে কিছু বলতে চান না। ফলে তারা তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়গুলোর দিকে বিকৃতভাবে আকৃষ্ট হয়—ইন্টারনেটসহ নানা মাধ্যমে সে তার মনের প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে থাকে, ভুলভাবে নিজের মনের আবেগের ঝড়কে নিয়ন্ত্রণ করে।
অজানাকে জানতে, নতুনকে আবিষ্কার করতে চায়। অ্যাডভেঞ্চার করার লোভে সে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। সেই সঙ্গে রয়েছে ‘পিয়ার প্রেশার’ বা সমবয়সীদের চাপ। এই চাপের কারণে সে ভাবে, বন্ধুদের মনমতো আচরণ না করলে সে দলছুট হয়ে যাবে। এ সময় সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, পরিবেশ আর বন্ধুরা হয়ে ওঠে তার ‘ডিসিশন মেকার’। সিগারেট আর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে সে কখনো কখনো।
সব সময় যে এই কারণগুলো দায়ী তা নয়, বাবা-মায়ের আচরণ আর নৈতিকতাও ওদের ওপর প্রভাব ফেলে। বাবা-মা যদি মিথ্যে কথা বলেন, সামাজিক নিয়মকানুন ও আইন ভাঙেন, পারিবারিক কলহ আর আগ্রাসী আচরণ করতে থাকেন, তবে সন্তানেরা ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’–এর কারণে সেই ধরনের আচরণগুলোই রপ্ত করে।
কিশোর-কিশোরীরা যে সব সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভেবেচিন্তে এই ভুলগুলো করে তা নয়, অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে আর বাবা-মা, শিক্ষকের ভয়ে আসন্ন শাস্তি থেকে রেহাই পেতে নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ভুল করে থাকে।
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে ‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’ নামে মানসিক রোগের কারণেও শিশু–কিশোরেরা ক্রমাগত সমাজবিরোধী ভুল আচরণ আর অন্যায় করে যেতে থাকে।
কী করবেন
কিশোরবেলার এই ভুলগুলোকে ‘ভুল’ হিসেবেই দেখতে হবে, অপরাধ হিসেবে শাস্তি দিতে গেলে বিপদ বাড়বে। শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। বিষয়টি বাবা-মা এবং স্কুলের শিক্ষকদের সমানভাবে বুঝতে হবে। ধরুন, একটি কিশোর মারামারি করেছে। বিষয়টি নিয়ে নালিশ না করে, তাকে কঠোর শাস্তি না দিয়ে বা আরেকজনের ঘাড়ে দোষারোপ করে নিজের সন্তানের পক্ষে সাফাই না গেয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাকে নিজের আচরণ পরিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে এবং তার কাছ থেকেই কথা আদায় করে নিতে হবে যে মারামারি করা খারাপ, এবং সে ভবিষ্যতে এমনটি আর করবে না। চাপ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে, স্নেহের পরশ দিয়ে তাকে বোঝাতে হবে।
কিশোরবেলার ভুলত্রুটি কমাতে যে বিষয়গুলোর দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা হলো—
ওদের বুঝতে শিখুন
ওদের বেড়ে ওঠার বয়সকে বুঝতে শিখুন। কী কারণে ওরা এই ভুল করছে সেটার ব্যাখ্যা গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে নিজের ওই বয়সের সঙ্গে তুলনা করুন।
দায়ী করবেন না
ভুলের জন্য তাকে দায়ী করবেন না। আচরণটি যে ‘ভুল’ ছিল সেটা ব্যাখ্যা করুন। কিন্তু এমনভাবে কথা বলবেন না বা তাকে তিরস্কার করবেন না, যেন সন্তান ভাবে সে নিজেই একটি ‘ভুল’ মানুষ। তাকে দায়ী না করে তার আচরণকে পরিবর্তনের জন্য বলুন। আবার অনেক সময় বাবা-মা সন্তানের এই ভুলগুলোর জন্য একে অপরকে দায়ী করেন—মা–বাবাকে আর বাবা মাকে। এই পারস্পরিক দায়ী করার প্রবণতা সন্তানকে তার ভুলগুলো করতে আরও উৎসাহিত করবে।
মারবেন না, বকবেন না
মারলে বা বকলে সে একধরনের ‘নেতিবাচক মনোযোগ’ পায়, এতে যে ভুলটির জন্য মারলেন বা বকলেন, সেই ভুলটি বারবার করার প্রবণতা দেখা দেয়। ভুল কাজটি করার জন্য সে ‘রি–এনফোর্সড’ হয়। এটা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। তাই মারপিট বা ধমকে সমাধান নেই।
একমুখী শিক্ষা নয়
পরিবারে আর স্কুলে যুগ যুগ ধরে একমুখী শিক্ষার প্রচলন রয়েছে। বাবা-মা নির্দেশ দেবেন, শিক্ষক আদেশ দেবেন সন্তান আর শিক্ষার্থীকে তা শুনতে হবে, মানতে হবে। এটি মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। আচরণের শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা বা একাডেমিক শিক্ষা হতে হবে হাতে–কলমে এবং অবশ্যই দ্বিমুখী, অর্থাৎ যে বিষয়ে (আচরণ, একাডেমিক) তাকে শিক্ষিত করতে চাচ্ছেন, সে বিষয়ে শিক্ষার্থীর বিশ্বাস আর ভাবনার জায়গাটি আমলে নিতে হবে। প্রত্যেকের জন্য একই শিক্ষা কার্যকর না–ও হতে পারে।
নিজের আচরণ ও নৈতিকতা
বাবা-মা আর শিক্ষকদের নৈতিক আর ন্যায়সংগত আচরণ করতেই হবে। নিজেদের আচরণ পরিবর্তন না করে সন্তানের আচরণ পরিবর্তন করতে চাওয়া দুঃসাহস ছাড়া কিছুই নয়।
সমালোচনা নয়
ভুলের জন্য সন্তানকে ক্রমাগত টিটকারী দেওয়া, সমালোচনা করা চলবে না। স্কুলে তাকে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আলাদা করে দেওয়া বিপজ্জনক। এতে তার ভুল আচরণ করার প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করতে হবে
অপরের মত, পথ, বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেওয়ার চর্চা পরিবার ও বিদ্যায়তনে থাকতে হবে। স্কুলে জাতি, ধর্মভেদে শিক্ষার্থীদের আলাদা করার প্রবণতা যেন না থাকে। অপরের মতের প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা না থাকলে শিশুর মধ্যে ঘৃণা আর আগ্রাসী আচরণ বাড়তে থাকবে।
সঠিক তথ্য দিন
বয়ঃসন্ধিকালে মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। সেগুলোর মিথ্যা ব্যাখ্যা দেবেন না, এড়িয়ে যাবেন না। সে কিন্তু নানাভাবে সেই তথ্যগুলো জেনে নেবেই, কিন্তু নিজে নিজে জানার পথটি হবে অবৈজ্ঞানিক আর ভুল। ফলে বাবা-মা আর শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে, ভুল পথে, ভুলভাবে কোনো কিছু জানার আগেই আপনি সঠিকভাবে, সঠিক পথে বিষয়টি সম্পর্কে তাকে জানিয়ে দিন। বিশেষত তার নিজের শারীরিক পরিবর্তন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় যদি সে বিজ্ঞানসম্মতভাবে না জানে, তবে সে ভুলত্রুটি করতেই পারে, সেই সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে অপরাধে এবং শিকার হতে পারে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের।
নিয়ম তৈরি
পরিবারের বা স্কুলে সবার জন্য নিয়ম তৈরি করুন। নিয়ম না মানার পরিণতি জানিয়ে দিন এবং সবার জন্য নিয়ম সমান রাখুন।
বন্ধু হন
সন্তানের বন্ধু হোন। তার দৈনন্দিন জীবনে আপনার অবস্থান নিশ্চিত করুন। আপনি বাবা হন আর মা হন, কিংবা শিক্ষক—আপনার সন্তান বা শিক্ষার্থীর সঙ্গে যেন মানসিক দূরত্ব তৈরি না হয়। সে যেন তার মনের কথা আপনার কাছে অকপটে বলতে পারে, তেমন সম্পর্ক তৈরি করুন।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ
‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’, মাদকাসক্তি বা অন্য কোনো মানসিক রোগের কারণে সে এ ধরনের ভুল আচরণ বারবার করছে কি না, এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।