এক দশক ধরে আমাদের দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে অনলাইন ব্যবসা। তবে তিন বছর আগেও এই গতি ছিল ধীর। এমন সময়ে করোনা যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এই ব্যবসায়ীদের জন্য। সবাই ঘরে আটকে পড়ায় হঠাৎই যেন অনলাইন কেনাকাটা কিংবা হোমমেড প্রোডাক্টের চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। আর অনলাইন কেনাকাটায় একবার যিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁর জন্য ‘অফলাইনে’ কেনাকাটা করা মহাদুর্যোগের নাম। ফলে চাহিদার সূত্র অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপকহারে বেড়েছে অনলাইন ব্যবসায়ীর সংখ্যা। আর এই অনলাইন ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ নারী।
পণ্যের দাম জানতে চেয়ে মেসেজ করে পরে আমাকে অশালীন ছবি আর ভিডিও পাঠান এক ব্যক্তি। আমি তখন নতুন ব্যবসায় এসেছি। তাই ভয় পেয়েছিলাম খুব
নারীদের জন্য বরাবরই ঘরের বাইরে কাজ করা বা নিজের কাজের জায়গায় নিরাপত্তা পাওয়া কঠিন। অনলাইনে সেই ভয় না থাকলেও রয়েছে অন্য চ্যালেঞ্জ। অপমানজনক মন্তব্য, অশ্লীল ছবি, বার্তা কিংবা ইঙ্গিত অথবা অকারণে হেনস্তা—তালিকাটা একদম ছোট নয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করেন, এমন কয়েকজন নারীর কাছে তাঁদের মন্দ অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে উত্তর কমবেশি একই রকম। ঈদে অনলাইন ব্যবসা যেমন বেড়েছে, হয়রানিও হতে হয়েছে সমানুপাতিক হারে।
অনলাইন ব্যবসায়ী সাদিয়ার (ছদ্মনাম) মতে, ‘বহুবার ব্যবসাবিষয়ক আলাপ ব্যক্তিগত বিষয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যখন পণ্যের দাম জানতে চেয়ে মেসেজ করে পরে আমাকে অশালীন ছবি আর ভিডিও পাঠান এক ব্যক্তি। আমি তখন নতুন ব্যবসায় এসেছি। তাই ভয় পেয়েছিলাম খুব। তবে সময়ের সঙ্গে এগুলো কীভাবে সামলে চলতে হয়, তা অনেকটাই শিখে গেছি।’ এদিকে ভর্তা বাহারের স্বত্বাধিকারী রুবাইদা রাখি জানালেন, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রশ্ন করা ‘নরমাল’ হয়ে গেছে। যার সঙ্গে তাঁর ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই।
আরেক অনলাইন ব্যবসায়ী আনিকা (ছদ্মনাম) এবারের ঈদে তাঁর ব্যবসাসংক্রান্ত খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘অনলাইনে নতুন কালেকশন নিয়ে লাইভ করার সময় বাবা, স্বামীর রোজগার কিংবা পারিবারিক মর্যাদার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে আজেবাজে মন্তব্য আসে। যদিও এগুলো পাশ কাটিয়ে কাজ করে যেতে চেষ্টা করি। তবে এ ধরনের মন্তব্য বড় ধরনের মানসিক ও পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
সানজিদা নামের আরেক ব্যবসায়ীর কথাতেও একই ধরনের বক্তব্য উঠে আসে। এর প্রতিকারে তিনি কী করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রথমত এড়িয়ে যাই। এরপরও যদি বারবার কেউ উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে তার সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনে আগ্রহী না, এ কথা জানিয়ে দেই। বাজে কথা বা গালাগাল করলে মাথা ঠান্ডা রেখে জবাব দেয়ার চেষ্টা করি। সেটা সম্ভব না হলে স্রেফ এড়িয়ে যাই।’
অনেকেই সানজিদার মতো দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি সামলাতে পারেন না। অনেক সময় বারবার এড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও অপরপক্ষ থেকে হয়রানি কমে না। অনেক নারী উদ্যোক্তা ফেক আইডির সঙ্গে ব্যবসায়িক কথা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তবে সব সময় তা সম্ভব হয় না। আর ব্যবসা করতে এসে এত কিছু এড়িয়ে চলা কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, সমস্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া বা এড়িয়ে চলা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তাই এড়িয়ে যাওয়া কিংবা লুকিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি দরকার প্রতিকার।
নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা এখন অনেক বেশি সংঘবদ্ধ ও সচেতন। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ আছে, যেখানে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। যে আইডি দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে, তা অন্যদের জানান। তিন গোয়েন্দার ‘ভূত থেকে ভূতে’র মতোই এই সচেতনতা কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে বেশ সফল। এর বাইরে মানসিক যে পীড়ন বা ভয়, সেটা সারিয়ে তুলতে মানসিক শক্তি জোগানোর জন্য আছে অনেক গ্রুপ। যেগুলো নারীদের এই পথচলা আরও সহজ করতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে, পদক্ষেপ নেয়। এ ছাড়া হয়রানির ঘটনা প্রয়োজনে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগকে জানাতে হবে। পুলিশের ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ এ ক্ষেত্রে ভালো উদ্যোগ। ৯৯৯ কিংবা তাদের হটলাইন ০১৩২০০০০৮৮৮–এ কল করে সাহায্য চাইতে পারেন হয়রানির শিকার নারীরা। আর লিখিত অভিযোগ করতে চাইলে cybersupport.women@police.gov.bd–তে মেইল পাঠানো যেতে পারে। তবে এসব অভিযোগ দেখে তদন্ত করে ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ কিংবা স্বচ্ছতার অভাবে সঠিক সমাধান পাওয়া কঠিন হয়।
যেহেতু বাংলাদেশে এখন অনলাইন ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে। তাই হয়রানি বন্ধে নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য আইন ও সহযোগিতা কার্যক্রম আরও প্রসারিত করা সময়ের দাবি। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের হয়রানি মোকাবেলা করা সহজ হবে। নারীরা আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করতে পারবেন।