গত ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তব্য দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে তাঁর আশাবাদের পাশাপাশি শঙ্কাও তুলে ধরেছেন তিনি।
আমাদের স্কুলে যে মেয়ে প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছিল, তার কথা এখনো আমার মনে আছে। নাম ফিয়োনা লিন্ডসে। ওর বাবা ছিলেন একজন স্থানীয় হিসাবরক্ষক। তিনি যখন অফিসের কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতেন, আমরা চাবি নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়তাম। বিশাল ডেস্কটপ কম্পিউটারটা চালু করতাম। সে কম্পিউটারের পর্দা এত বড় ছিল যে যন্ত্রটাকে জায়গা দিতে ডেস্কটা রীতিমতো হিমশিম খেত।
এটা ১৯৯০ দশকের কথা। এখনকার তুলনায় যন্ত্রটা শুধু দেখতে ভিন্ন ছিল তা নয়, তখন ইন্টারনেটের ব্যবহারও ছিল আলাদা। ওটা ছিল একটা আধুনিক হ্যাম রেডিও। ডায়াল করে কারও সঙ্গে কথা বলা যেত। এর মধ্যে বাস্তব জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগের আনন্দটা ছিল।
কিন্তু যখন একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আরও বিস্তৃত হলো, আমরা তা-ই করলাম, যা মানুষ সব সময় করে এসেছে। সংঘবদ্ধ হলাম।
সংযোগ ও পুনঃসংযোগের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্ম হয়েছিল। দলে দলে আমরা যোগ দিয়েছি। আমাদের ভাবনা, অনুভূতি, আইডিয়া মুক্তভাবে প্রকাশ করেছি। আমরা ভাগাভাগি করেছি তথ্য, উপাত্ত, সত্যের মুখোশ পরা কল্পনা, মিম এবং বিড়ালের অজস্র ভিডিও। আমরা চিন্তাভাবনা করার একটা নতুন জায়গা পেয়েছি। আমাদের বৈচিত্র্য উদ্যাপন করার একটা সুযোগ পেয়েছি।
কিন্তু একই সঙ্গে আমরা এ কাজগুলো করা ভুলে যেতে শুরু করেছি।
‘যেসব রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে আমি একমত নই, সেসব বিষয়েও অপরের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝার জন্য একটা শ্রদ্ধাশীল আলোচনায় বসতে চাই’—এ নামে কখনো কোনো গ্রুপ তৈরি হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
মানুষ হিসেবে সহজাতভাবেই আমরা ‘আমার মতো করে ভাবে’, এমন লোকের দল ভারী করতে চাই। ভিন্নমতাদর্শীদের এড়াতে চাই। আর আমরা যা খুঁজি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম আমাদের সামনে তা-ই হাজির করে; এমনকি কখনো কখনো খোঁজ শুরু করার আগেই।
সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো-মন্দ বলার জন্য আমি এখানে আসিনি। এটা একটা টুল। কিন্তু এর গুরুত্ব অনেক। আমরা যতটা ভাবছি, তার চেয়েও বেশি।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে সন্ত্রাসীদের হামলায় ৫১ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন। নৃশংস এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। রয়্যাল কমিশনের তদন্তে জানা গেছে, সন্ত্রাসীরা অনলাইনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিল।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনা থেকে আমরা আমাদের দায়িত্ববোধটা টের পেয়েছি। আমরা জানতাম, বন্দুকনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দরকার। সেটা আমরা করেছিও। কিন্তু এ-ও জানতাম, যদি সত্যিকার অর্থেই অনলাইনের এই সহিংস মৌলবাদ সমস্যার সমাধান চাই, তাহলে সরকার, সুশীল সমাজ ও টেক কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আর সে জন্যই ক্রাইস্টচার্চ কল টু অ্যাকশনের (সন্ত্রাস ও সহিংস মৌলবাদ নির্মূলের জন্য এটি জেসিন্ডা আরডার্নের একটি উদ্যোগ—বি. স.) জন্ম।
ব্যক্তিগতভাবে আমরা কী করছি, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং একটা কথা খুব প্রচলিত—কি–বোর্ডযোদ্ধা। এ আখ্যা মূলত তাদের জন্য, যারা অনলাইনে আক্রমণাত্মক কিংবা কুরুচিপূর্ণ পোস্ট করে। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, তারা নিজেদের সত্যিকার পরিচয় লুকিয়ে রাখে। কি–বোর্ডযোদ্ধা কথাটা আমার পছন্দ হয়েছে। যখনই আমার ফিডে বিচ্ছিরি কোনো লেখা চোখে পড়ে, কল্পনায় দেখতে পাই, লেখাটা লিখছে একজন একাকী মানুষ। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বালাই যার নেই। পরনে বেঢপ একটা সুপারহিরো কস্টিউম।
কি–বোর্ডযোদ্ধা বলি আর যা-ই বলি, যারা এসব লেখে, তারা তো মানুষ। যারা পড়ে, তারাও।
আমার সোশ্যাল মিডিয়ার দেখভাল আমি নিজেই করি। যা-ই বলি, এটাই তো নতুন দিনের ‘টাইম স্কয়ার’। কিন্তু আমরা সবাই জানি, আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু তথ্য আর খবরই দেয় না।
মূলধারার গণমাধ্যমের জবাবদিহি থাকে, সাংবাদিকতার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু অন্য অনেকে, যারা আমাদের কাছে তথ্য উপস্থাপন করে, তাদের থাকে না। তোমাদের ক্যাম্পাসেই এমন অনেককে পাবে, যারা বলবে ভুল তথ্য কিংবা গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণ স্রেফ অ্যালগরিদম বা ট্রল নয়; বরং দশক ধরে গড়ে ওঠা অসামঞ্জস্যপূর্ণ গণমাধ্যমের কাঠামো। তবে মূল কথা হলো, আমরা এখন যে অবস্থার মধ্যে পড়েছি, তা নতুন নয়। একাধিক কপি তৈরি করে কিংবা ছড়িয়ে দিয়ে সাহায্য করে, এমন যেকোনো প্রযুক্তিই খবর আর গুজবের পালে হাওয়া দেয়। হোক সেটা ফটোকপি মেশিন কিংবা ক্যাসেট টেপ। অতীতের তুলনায় এখন শুধু একটা জিনিসই বদলেছে, আর সেটা হলো গতি।
যে চিত্র আমি তোমাদের সামনে তুলে ধরছি, সেটা একটু অতিরঞ্জন মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি খুব আশাবাদী একজন মানুষ। আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ বদলে ফেলতে পারব না, কিন্তু নিজেদের তো বদলাতে পারি। যত বাধাই আসুক, আমরা আরও শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারি। আর সে রকম উদাহরণ আমি প্রতিদিনই দেখতে পাই।
লিয়াহ বেল ও ওয়াইমারামা অ্যানডারসন নিউজিল্যান্ডের ওটোরোহাঙ্গা কলেজের দুই ছাত্র। তাদের মাথায় প্রশ্ন এসেছিল, প্রত্যেক নিউজিল্যান্ডার কেন নিজ নিজ স্কুলে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে শিখবে না? এই দুই ছাত্র একটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছে। তারা পিটিশন সাইন করে সংসদে জমা দিয়েছে। সফলও হয়েছে। পরের বছর থেকে আমাদের তরুণেরা তাদের অতীত, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে শিখতে শুরু করেছে।
আমাদের তরুণেরা কী শিখছে, সেটাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়; কীভাবে শিখছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভুল তথ্য ও গুজবের এই যুগে আমাদের তথ্যের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করা জানতে হবে। এর মানে ‘অবিশ্বাস’ শেখানো নয়। আমার ইতিহাসের শিক্ষক বুড়ো মিস্টার ফাউন্টেন যেমনটা বলেছিলেন: ‘একটা ছোট্ট তথ্যের সীমাবদ্ধতাগুলোও বুঝতে হবে। প্রতিটি ঘটনা বা সিদ্ধান্তকেই অনেক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়।’
পক্ষপাত তোমাকে সব সময় ঘিরে রাখবে। তুমি আরও বেশি ভুল তথ্যের মুখোমুখি হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমার চারপাশের ‘কোলাহল’ আরও খারাপের দিকে যাবে।
একটা তথ্যকে তুমি কীভাবে কাজে লাগাও, কীভাবে তর্ক-বিবাদের মুখোমুখি হও, খবরের টোপ দিলেই তুমি লুফে নাও কি না—এসবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামনে শত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে গিয়ে; সিস্টেম আর ক্ষমতার ধন্দে পড়ে, ছোট ছোট পদক্ষেপের কার্যকারিতা ভুলে যেয়ো না। নিজের জায়গা থেকে আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো প্রভাব ফেলতে পারি। বৈচিত্র্যকে সমানুভূতি ও উদারতা দিয়ে গ্রহণ করতে পারি। বৈচিত্র্য ও বিভাজনের মাঝখানে কিছু মূল্যবোধ থাকে। যে মূল্যবোধ আমরা আমাদের শিশুদের শেখাই। অথচ সেই একই মূল্যবোধ নেতাদের মধ্যে থাকলে সেটাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়।
বৈচিত্র্য আমাদের বড় করে, আর বিভাজন করে ছোট।
চলো, আমরা বরং উদারতা দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হই। (নির্বাচিত অংশ)