জেসন মোমোয়া

বেড়ানোর নেশা আমাকে মনোযোগী ছাত্র বানিয়েছে

জেসন মোমোয়া
জেসন মোমোয়া
>

মার্কিন অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক ও লেখক জেসন মোমোয়া। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি আকুয়াম্যান ২০১৮ সালে হলিউডের ব্যবসাসফল ছবিগুলোর একটি। অনেক সংগ্রামের পর পৌঁছেছেন আজকের অবস্থানে। সেই সংগ্রামের গল্পই জেসন বলেছেন একটি তথ্যচিত্রে।

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই আমি একটা পরিবার চাইতাম, বাবা হতে চাইতাম। কিন্তু জীবনে কোনো দিনই অভিনেতা হতে চাইনি। মা ছিলেন পুরোদস্তুর একজন শিল্পী। সব সময় নতুন কিছুর খোঁজে থাকতেন। বলতে পারেন আমি আমার মায়ের সেই চোখ পেয়েছি। মা আমাকে পাথুরে রাস্তায় স্কেটবোর্ড চালানো শিখিয়েছেন, পাহাড়ে চড়া শিখিয়েছেন। পাহাড়ে চড়া আমাকে শিখিয়েছে সব ধরনের ভয় আর সংশয়ের মুখোমুখি হতে, সব অসম্ভবের সমাধান আবিষ্কার করতে, চলার পথের সব বাধা না থেমে উতরে যেতে।

আমি পাহাড় বেয়ে ওপর থেকে পৃথিবী দেখতে চাইতাম। রাস্তা, বনে-জঙ্গলে ছুটে বেড়াতে চাইতাম। ঘর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে চাইতাম। বাঁধনহারা হয়ে তিব্বত থেকে ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র—সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। আমার এই ঘোরাঘুরির নেশা আমাকে এক মনোযোগী ছাত্র করে তুলেছিল, যে ঘুরে ঘুরে জীবনের ব্যাপারে নানা কিছু শিখত। চলতে চলতে একসময় অভিনয়ের ঝোঁক আমাকে পেয়ে বসল। একটা অস্থির মানুষ সেই সময় নিজের গন্তব্য ঠিক করার সুযোগ পেল। ভ্রমণের সেই নেশা আমাকে অভিনেতা হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাগিদ দেওয়া শুরু করল। অভিনেতা হয়ে আমি কখনো একজন নরসুন্দর হলাম, কখনো বার টেন্ডার। কখনো আবার হলাম আটলান্টিসের রাজা। ১৯ বছর এভাবেই নিজের আকাঙ্ক্ষা আর লক্ষ্যকে তাড়া করেই চললাম। এখন আমি অভিনেতা, আমি নির্মাতা। আমি লিখি, আমি প্রযোজনা করি। চলতে চলতে আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছি। আমি একজন শিল্পী। আমার শিল্প গল্পবলা।

এরপর আমার জীবনে সে এল। আমার সঙ্গী, আমার জীবনের ভালোবাসা, আমার সব দুষ্টুমির অংশীদার। আমি খুব বোকার মতো, পাগল হয়ে তার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমার স্ত্রী আমাকে সুস্থ, সুন্দর তিনটি দেবশিশু দিয়েছে—জোজো বিয়ার, আমার আদরের লোলা বিয়ার আর ওল্ফ। তাদের পাওয়ার পর আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি বাবা হতে পেরেছি। আমি অবশেষে পুরো পৃথিবীতে আমার নিজের একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছি, আমার ঘর খুঁজে পেয়েছি। সব বাবার মতো আমিও চাই, আমাদের সন্তানেরা আমাকে সেই কাজটাই করতে দেখুক, যা করে আমি আনন্দ পাই। কিন্তু আমার গল্প বলার আকাঙ্ক্ষাটা আমাকে তাঁদের থেকে দিনের পর দিন দূরে সরিয়ে রাখে। আর সেই দূরত্বটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। যে ঘুরে বেড়ানোটা একসময় আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাত, সেই ঘুরে বেড়ানোর আকাঙ্ক্ষাই না জানি এখন আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়! আমার পরিবারকে না জানি এই দূরত্ব ছিনিয়ে নেয়!

আমি ভয় পাই, না জানি আমি কোন মূল্যবান মুহূর্ত হাতছাড়া করছি—ওদের হাসি, ওদের কান্না, ওদের হাত ধরে হাঁটা, ওদের নানা কিছু শেখানো—আমি কোনো মুহূর্ত হাতছাড়া করতে চাই না। কারণ, আর কয়েকটা বছর পরই তো আমি আর তাঁদের পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকব না। আর কয়েকটা বছর পরই ওদের জীবনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আমার সব নিজস্বতা, সব গুণ, সব শিল্প নিয়ে তাদের ঘিরে থাকব। কারণ, আমি তাদের স্কেটবোর্ডিং শেখালে তবেই তো তারা সেই স্কেটবোর্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে, জীবনে ভারসাম্য খুঁজে পাবে, সবকিছু মোকাবিলা করার সাহস পাবে। আমি তাদের পাহাড়ে চড়া শেখালে তারাও তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে উঠতে পারবে সবার ওপরে, ভয় আর সংশয়কে গর্বের সঙ্গে উড়িয়ে দিতে পারবে।

আমি সন্তানদের শিখিয়েছি আমাদের প্রকৃতিকে, প্রাকৃতিক সম্পদকে শ্রদ্ধা করতে। কারণ, প্রকৃতির শুদ্ধ রংকে চিনতে শিখলে তারা সবকিছুর সুন্দর রূপটা দেখতে পাবে, প্রতিটি জিনিসের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম দিকেও চোখ যাবে। আমি তাদের আমার দৃষ্টিটা দিতে চাই। তারা শিল্পকে জানবে, তারা আঁকবে, তারা ভাস্কর্য বানাবে। তারা আলো আর অন্ধকারের মিশেলটা বুঝবে। তারা তাদের আত্মাকে খুঁজে পাবে। সেখানেই খুঁজে পাবে, যেখানে থাকবে সুর। তাই আমি তাদের সুর তুলতেও শেখাব। যেন তারা সুর নিয়ে খেলতে পারে, সেই সুরে গাইতে পারে, নাচতে পারে, নেচে নেচে জীবনকে উপভোগ করতে পারে, উদ্​যাপন করতে পারে। এই সবকিছু তাদের আবেগকে প্রকাশ করতে শেখাবে।

আমার সঙ্গে আমার একটা পুরোনো প্যান্ট থাকে সব সময়। প্রতিবার আমার ওই ছেঁড়া প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতর একটা অদ্ভুত শক্তি খুঁজে পাই। এটার নানা জায়গায় রং মাখা, কাঁচা হাতে ছেঁড়া জায়গাগুলো সেলাই করা। প্রতিটা দাগ, প্রতিটা আঁচড়, প্রতিটা রঙের ছোপ আমার ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার সাক্ষী, তাদের হাসি-কান্নার খেরোখাতা। প্রতিটা চিহ্নই একেকটা স্মৃতি। প্রতিটা ছেঁড়াফাটাই আমাকে আমার জীবনের প্রতি মুগ্ধ করে। আমি যা চেয়েছি, এই প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে রাখা আছে। একদিন আসবে, যখন আমি থাকব না। সেই দিন আমার সন্তানেরা, তাদের সন্তানেরা আমার ছেঁড়াফাটা রংমাখা প্যান্টটা হয়তো ঘরের কোনো ধুলোমাখা কোনায় খুঁজে পাবে। সেটা হাতে নিয়ে তারা বুঝতে পারবে এটা আসলে আমার জীবনের ক্যানভাস ছিল।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: কারহার্ট হ্যান্ডমেইড ফিল্মস