বৃষ্টিতে বাইকে করে সাজেক ভ্রমণ

মেঘের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় পর্যটকদের গায়ে।
মেঘের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় পর্যটকদের গায়ে।

কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে পাহাড়ে। আর এমন সময়ে সবুজ পাহাড়ে ডানা মেলেছে মেঘ। সবুজের বেষ্টনীতে কেবলই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা! ভোরে বৃষ্টি হওয়ায় মেঘে প্রবেশ করে শোয়ার ঘর পর্যন্ত। পাহাড়ের মেঘ কখনো ধরা দেয় সমুদ্রের রূপে। সবুজ উপত্যকা, অপার্থিব সূর্যোদয়, জোছনায় ছড়িয়ে পড়া মেঘের দল, আকাশের মেঘের অনেক রং মিলিয়ে সাজেক যেন অন্য জনপদের গল্পমালা। এক জাদুকরী প্রকৃতির রহস্য ঘেরা উপত্যকা।

মোবাইলের শব্দে বুধবার ভোর ৫টায় ঘুম ভাঙল। মিশুর কলে। ভাই, বাইরে তো অনেক বৃষ্টি; কেমনে যাবেন? উল্লেখ্য, আমাদের আজ একসঙ্গে সাজেক যাওয়ার কথা। কিন্তু সারা রাত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। সকালে মুষলধারে বৃষ্টির কারণে দুজন যাবে না বলছে। আবার সাড়ে ৫টায় কল দিয়ে বন্ধু রুবেল বলছে যাবি না? ভাবলাম অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেলছি, এরপর তো আর পাব না। তাই রুবেলকে বলে দিলাম, আমি তো বের হয়ে গেছি সঙ্গে মিশু ও মিজানকে নিয়ে।

আমরা সাতজন (অভি, শুভ, মিশু, মিথুন, মিজান, রুবেল ও আমি) ৬টা বাইক নিয়ে অক্সিজেন মোড়ে একত্রিত হই। ওখানে চা-নাশতা খেয়ে একটা সেলফি তুলে রওনা দিলাম সাজেকের উদ্দেশে। অনেক জায়গায় খানাখন্দ সড়ক ও বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চলছে আমাদের বাইক। বৃষ্টির কারণে গতি কমিয়ে চালানো হচ্ছে বাইক। আমরা মানিকছড়িতে গিয়ে যাত্রাবিরতির জন্য থামি। ওখানে চা-নাশতা খেয়ে আবার রওনা দিলাম খাগড়াছড়ি উদ্দেশে।

রাঙামাটির সাজেকে গড়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য ছোট ছোট অনেক কটেজ।

খাগড়াছড়ি থেকে রওনা হয়ে প্রথমে যেতে হয় দীঘিনালার পথে। রাস্তার দুই পাশে রাবার বাগান। সাজানো সবুজ মিশ্র ফলের বাগান। পাহাড়ের বুকে বসবাস করা আদিবাসীদের বসতি। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথের বাঁক পেরোতে পেরোতে স্বাগত জানাবে পাহাড়ি-বৃষ্টি। যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশের দীঘিনালা বন বিহারে একটু ঘুরে দেখাতে পারেন। দীঘিনালার পথ পাড়ি দিয়ে কিছুটা সামনে গেলেই বাঘাইহাট বাজার। বলতে গেলে এখান থেকেই রাঙামাটির সীমানা শুরু। ছোটখাটো ছিমছাম পাহাড়ি বাজার। প্রয়োজনীয় খাবার এখান থেকে কিনে নিতে পারবেন। সময় থাকলে বাজারের আশপাশটা ঘুরে দেখবেন।

বাঘাইহাট বাজার ছেড়ে যেতেই বড় বড় সব পাহাড়ি রাস্তা। বাইকের পেছনে বসে মনে হবে এই যেন রোলার কোস্টার। এক পাহাড় থেকে নেমে তীব্র গতিতে উঠতে হয়ে আরেকটি পাহাড়ে। দুই পাশে তাকালে চোখে পড়বে কেবল সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টিতে ন্যাড়া পাহাড়েও সবুজের সমারোহ। কাছে বা দিগন্তের পাহাড়গুলো অঝোর ধারার বৃষ্টির সৌন্দর্য রূপ মোটরসাইকেল চালিয়ে উপভোগ করা যায়। ঘনবৃষ্টিতে পাহাড়ে খুব বেশি দূর দেখাও যায় না।

পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কটেজ।

বাঘাইহাট থেকে ছোট-বড় পাহাড় ডিঙিয়ে বৃষ্টি আর মেঘমল্লার সঙ্গে পৌঁছাতে হয় মাচালং বাজারে। এর পরেই শুরু হয় সাজেকের প্রধান পথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট ওপরে সাজেক। অসংখ্য পাহাড়ের বন্ধনে সবুজে ঢাকা অপরূপ সাজেকের রাস্তা! বৃষ্টিতে সবুজে ঢাকা এই পথ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কালো মেঘ বারবার হাতছানি দেয় বৃষ্টি। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে প্রায়শ। দারুণ বৃষ্টিমুখরে খুঁজে পাবেন সাজেকের প্রকৃত সৌন্দর্য।

সবুজ পাহাড়ের চূড়া ঘিরে রয়েছে সাদা মেঘের আবরণ। দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা মিশে গেছে মিজোরামের নীল পাহাড়ে (ব্লু মাউন্টেইন)। বর্ষায় সাদা তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘের স্তূপ ভেসে বেড়ায় পাহাড়ের বুকে। উপত্যকার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হবে এই কী অপার্থিব সৌন্দর্য!

বৃষ্টির পর সাজেকের অন্য রূপ দেখা যায়। সাদা মেঘে ঢেকে যাওয়া রুইলুই পাড়া, পাইলিং পাড়া ও সাজেক ভ্যালির পাহাড় চূড়া। বর্ষায় মেঘের দল আপনাকেও ভিজিয়ে দেবে। পাহাড়ের আকাশে মেঘের পেখম থেকে অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টির স্রোতোধারা।

সাজেকে পাহাড়ি নারীরা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি আনছেন।

কীভাবে যাবেন
সাজেকের অবস্থান রাঙামাটিতে হলেও যেতে হয় খাগড়াছড়ি শহর হয়ে। চট্টগ্রাম অক্সিজেন মোড় থেকে নন এসি বা এসি বাসে সরাসরি খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। প্রতিদিন শান্তি পরিবহন, শ্যামলী, এস আলম, সেন্টমার্টিন পরিবহনসহ বিভিন্ন বাস খাগড়াছড়িতে যাতায়াত করে। তা ছাড়া রাঙামাটি থেকে লঞ্চে করে লংগদু বা বাঘাইছড়ি হয়ে সাজেক পৌঁছানো যায়।

প্রয়োজনীয় তথ্য
সাজেক খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। সাজেকে রাতযাপন করতে গেলে ভ্রমণের আগে অবশ্যই রুম বুকিং এবং যাতায়াতের ‘চাঁন্দের গাড়ি’ নিশ্চিত করতে হবে। সাজেকের বাঘাইহাট থেকে সকাল সাড়ে ১০টায় এবং বিকেল তিনটায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পর্যটক আসা-যাওয়া করে। তার আগে-পরে কোনো পর্যটক আসা যাওয়া করতে পারে না। তা ছাড়া সাজেকের পাহাড়ি রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে স্থানীয় ‘চাঁন্দের গাড়ি’ বা পিকআপে যাতায়াত করাই ভালো।

রাঙামাটির সাজেকের জিরো পয়েন্ট এলাকায় আমরা।