বুড়িয়ে যাওয়াকে ভয় পান না এমন কি কেউ আছেন? মনে হয় নেই। আসলে আমরা ভয় পাই বৃদ্ধ বয়সের কর্মতৎপরতায় শিথিলতাকে। দৈনন্দিন কাজে পরনির্ভরশীলতা, শরীরের কলকবজা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসক, হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া, মৃত্যুভয়, কপালে, গলায় চামড়ার ভাঁজ, সাদা চুল, আশপাশের লোকজনের অবজ্ঞা আর অবহেলা; এসব নিয়ে নানা আশঙ্কা। আর এটা যখন মনে গেঁথে বসে তখনই ভয়, উদ্বেগ, আড়ষ্টভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে মানসিক রোগের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
কেন মানুষ বুড়ো হয়?
প্রকৃতির নিয়ম এটাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বাড়বে। নারী-পুরুষের বয়সজনিত পরিবর্তনের তফাত রয়েছে। আর এর কারণও ভিন্ন।
আয়ু: বিশ্বব্যাপী নারীদের আয়ুষ্কাল পুরুষদের তুলনায় বেশি। পুরুষদের কাজের ধরন, সামাজিক আর মানসিক চাপ নারীর তুলনায় বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। মদ্যপান, ধূমপান ইত্যাদিও প্রভাব ফেলে।
হরমোন: নারীদের হরমোন ইস্ট্রোজেন ৪৫ বছরের পর থেকে কমতে থাকে বা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। একে মেনোপজ বলে। আর পুরুষের হরমোন টেস্টোস্টেরন খুবই ধীরে কমে। একে এন্ড্রোপজ বলে। পুরুষদের বেলায় ত্রিশের পর প্রতিবছর ১ শতাংশ করে কমে। কিন্তু পুরুষেরা সন্তান উৎপাদনক্ষমতা মোটামুটি আমৃত্যু ধরে রাখতে পারে।
ত্বকের পুরুত্ব: পুরুষদের ত্বক নারীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ পুরু। পুরুষের হরমোন টেস্টোস্টেরন এর কারণ। কোলাজেন ঘনত্ব, প্রাকৃতিক ময়েশ্চার পুরুষদের অনেক বেশি। তাদের ঘাম বেশি হয় এবং তাতে ল্যাকটিক অ্যাসিড থাকায় ময়েশ্চারসমৃদ্ধ ত্বক প্রকৃতিপ্রদত্ত। নারীর মেনোপজের প্রথম পাঁচ বছর কোলাজেন একটু বেশি হারে কমতে থাকে এরপর ধীরে কমে। আর পুরুষদের কোলাজেন কমে ধীরে ধীরে। ত্বক কুঁচকে যাওয়া রোধে মহিলাদের রূপচর্চা, ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রাকৃতিকভাবেই লক্ষণীয়।
চুল পড়ে যাওয়া: পুরুষদের টাক পড়ে ৫০ বছরের কাছাকাছি গিয়ে। আর নারীদের চুলের ঘনত্ব কমতে থাকে।
ওজন: নারীদের ওজন বাড়ে ৬৫ আর পুরুষদের ৫৫ বছর পর্যন্ত। এরপর উভয়েরই কমতে থাকে। শরীর দুর্বল হতে থাকে।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা: যেসব পুরুষের স্থূলতা বা ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক হয়েছে, তাদের স্মৃতিভ্রমের আশঙ্কা বেশি। আর যেসব নারী অন্যের ওপর নির্ভর করে, কাজকর্ম কম করে, লোকজনের সঙ্গে কম মেলামেশা করে তাদের স্মৃতিভ্রমের আশঙ্কা বেশি।
পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বৃদ্ধ বয়সটাকে মেনে নেয় সহজেই। তবে কিছু ব্যাপার মানতে তাদের কষ্ট হয়। যেমন শারীরিক দুর্বলতা, উদ্দেশ্যবিহীন বেঁচে থাকা, যৌনক্ষমতা কমে যাওয়া, অন্যের ওপর নির্ভরতা, স্মৃতিবিভ্রাট ইত্যাদি। পুরুষ-নারী উভয়ই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক সৌন্দর্য হারায়। তবে এই হারানোটা নারীদের বেলায় সাধারণত বেশি চোখে পড়ে।
জেরোন্টোফোবিয়ার লক্ষণ কী?
জেরোন্টোফোবিয়া একধরনের উদ্বেগজনিত রোগ। বুড়িয়ে যাওয়ার ভয় বা বৃদ্ধলোকদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা এ রোগের লক্ষণ। এই মানসিক রোগ যেকোনো বয়সে পুরুষ ও নারীর হতে পারে। মানসিক চাপ, বয়স্ক আত্মীয়স্বজন এমনকি রাস্তাঘাটে বৃদ্ধদের সহায়ত্ব তাদের মনে পীড়া ও নাড়া দেয়। বৃদ্ধ লোকদের সামনে দেখলে বা ছবি দেখলেও তাদের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ যেমন অস্থিরতা, ঘেমে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করার উপসর্গ দেখা দেয়। বৃদ্ধ বয়সের সীমাবদ্ধতা, অসুস্থতা, অবধারিত মৃত্যু ইত্যাদি চিন্তা এই রোগীদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে। এই অহেতুক চিন্তা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারে না। পরে এটা মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। তখন রীতিমতো চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
কী করণীয়?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি। চিন্তাগুলো স্বাভাবিক কিন্তু মেনে নিতে না পারা অস্বাভাবিক। জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ এই বৃদ্ধকাল। আর এই অপরিহার্য বিষয়ের চিন্তা নিজের অজান্তে ওসিডি রোগের মতোই মানুষকে কষ্ট দেয়। এই চিন্তাকে উপেক্ষা করতেই হবে। সুস্থ থাকতেই হবে। এর জন্য রয়েছে ওষুধ আর সাইকোথেরাপি। সঙ্গে নিজের সদিচ্ছা। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা উচিত। তাতে এ রকম মানসিক সমস্যা থেকে আমরা আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে পারব।
সুলতানা আলগিন
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা