গা থেকে কাঁথা টেনে না নেওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটানো এই আপনাকেই বিয়ের পর কাকডাকা ভোরে ছুটতে হতে পারে বাজারে। কোনোদিন চুলার আঁচ না নিয়ে ব্যাচেলর জীবন পার করা আপনাকে বিয়ের পর হয়তো ঘরে তিন বেলা কী রান্না হবে সেই সিদ্ধান্তও নিতে হবে।
বিয়ে করতে যাচ্ছেন মানে আজীবন আরেকজনের সঙ্গে বন্ধনে জড়াতে যাচ্ছেন। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হওয়ার আগেই তাই দরকারি কিছু বিষয়ে সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া ভালো।
১. পছন্দ-অপছন্দ
বিয়ের কথা শুরু হলে আপনারাও নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে থাকুন। গল্পচ্ছলে একজন আরেকজনের পছন্দ বা অপছন্দের বিষয়গুলো জেনে নিতে পারেন, এতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। কোনো বিষয়ে যদি আপনার দ্বিমত থাকে, সেটাও সরাসরি তখনই বলে নিতে পারেন। আবার অপর পক্ষেরও আপনাকে জানার সুযোগ তৈরি হবে। এটা সম্বন্ধ করে বিয়ের বেলায় তো বটেই, প্রেমের বিয়েতেও আরেকবার ঝালাই করে
নেওয়া ভালো। এতে সংসার শুরু হওয়ার পর কিছু বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি থাকবে। আর এই বিষয়গুলো সব হয়তো তালিকা ধরে বলা সম্ভব না, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতেই পারেন।
২. আর্থিক ব্যবস্থা
বিয়ের পর শুধু প্রেম দিয়ে দাম্পত্য সুন্দর রাখা সম্ভব নয়। যখনই সেখানে আর্থিক সংকট দেখা দেবে, তখনই অশান্তি দানা বাঁধবে। ‘অভাব এলে প্রেম জানালা দিয়ে পালায়’—বহুল প্রচলিত এই কথাটি তো আর এমনি এমনি আসেনি। তাই বিয়ের আগেই বুঝে নিন আপনার আর্থিক বিষয়ে সঙ্গীর প্রত্যাশা কী। তিনি কি সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছেন, নাকি টাকার প্রাচুর্যে? সঙ্গী যদি ছোটবেলা থেকে অঢেল টাকাপয়সা খরচে অভ্যস্ত না হয়, তাহলে আপনার জন্য বিষয়টি স্বস্তির। অনেকে সঙ্গী বা তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখে দ্রুত বিয়ে সেরে নিতে চান। এ সিদ্ধান্ত আপনার পরবর্তী জীবনের জন্য সুখকর না–ও হতে পারে।
৩. কোথায় থাকবেন
সাধারণত আমাদের দেশে বিয়ের পর কনেকে নিয়ে আসা হয় স্বামীর গৃহে। সেখানে কেউ হয়তো বাবা, মা, ভাইবোনসহ থাকেন, কেউ আবার আরও বড় পরিসরে। এখানেই তৈরি হয় সংকট। মেয়েটি হয়তো ‘নিউক্লিয়ার’ পরিবারের ছোট পরিসরে বড় হয়েছে। এত বড় পরিবারে থেকে সে অভ্যস্ত নয়। আবার স্বামী-স্ত্রী কর্মজীবী হলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে আবাস থেকে কতটা দূরে কর্মস্থল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মনোবিজ্ঞানী জানান, তাঁর চেম্বারে সম্প্রতি ঢাকা শহরের এক জনপ্রিয় (বিত্তবান) দম্পতি এসেছিলেন। সংসার শুরুর তিন মাসের মধ্যেই থাকার জায়গা (বাসা) নিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন এই দম্পতি। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন স্ত্রী, আলাদা বাসা নিতে চান তিনি। কারণ হিসেবে বলছেন, শাশুড়ির সবকিছুতে অতি আগ্রহ। সারা দিন অফিস শেষে বাড়িতে ফেরার পর স্বামীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর ফুরসতও পান না। এদিকে আবার ঘরের সব কাজ মেয়েটিকেই করতে হয়। ছোটবেলা থেকে হোস্টেলে বড় হওয়ার কারণে তিনি থাকতে চান নিজের মতো করে। যা এখানে সম্ভব হচ্ছে না। হয় আলাদা বাসা নিতে হবে; অথবা মেয়েটি এ বিয়ে আর এগিয়ে নিতে চান না।
৪. সন্তানসন্ততি
আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অনেকেই বিয়ের আগে বিষয়টি নিয়ে হয়তো আলোচনা করতে দ্বিধায় পড়েন। তবে নিজেদের মধ্যে সন্তানাদি নিয়ে আলোচনা করে নেওয়াও ভালো। কত দিন সন্তান নিতে চান না, কয়টা সন্তান চান; কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা এগিয়ে রাখা যেতে পারে। সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে একেকজনের ভাবনা হয়তো একেক রকম থাকে, তাই আলোচনা করে নেওয়াই ভালো। সন্তানকে কোন বয়সে কতটা স্বাধীনতা দেবেন, নাকি দেবেন না, সেসব আলোচনায় দুজনের মতামত কাছাকাছি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে দাম্পত্যে তিক্ততা আসবে। এখানে আরেকটি বিষয় দুজনের আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হওয়া জরুরি, সেটা হলো, নিজের অপূর্ণ অনেক ইচ্ছা বাবা-মা সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করবেন বলে ঠিক করে রাখেন। যা মোটেও উচিত নয়। আপনারা হয়তো তাকে সেই পরিবেশটা তৈরি করে দিতে পারেন, সেটা গ্রহণ করা বা না করার স্বাধীনতা সন্তানের থাকা উচিত।
৫. কাজকর্ম
বিয়ের পর নতুন বউয়ের বাইরে কাজ করার ব্যাপারে অনেক পরিবারে আপত্তি থাকতে পারে। তাই বিয়ের আগেই পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। এই সিদ্ধান্ত পাত্র-পাত্রীদেরই নিতে হবে। ঘরের কাজ মানেই স্ত্রী করবে, আপনার সঙ্গীর মধ্যে এই ভাবনা থাকলে বিয়ের আগে আরেকবার ভাবতে পারেন। আলোচনাটা হতে পারে ভাগাভাগি নিয়ে। কেউ হয়তো বাজারের দায়িত্ব নিলেন, কেউবা রান্না। আবার একদিন বাসন মাজলেন স্বামী, স্ত্রী হয়তো ঘরদোর পরিষ্কার করলেন। দুজনের সংসারে উপার্জনে যেমন দুজনেরই অবদান থাকা জরুরি, তেমনি কোথাও বিনিয়োগ করতে চাইলেও দুজনের মতামত থাকতে হবে।
৬. অভ্যাস
মানুষের কিছু অভ্যাস ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠে। যার কিছু হয়তো ঠিক, কিছু ভুল। তবে ঠিক–ভুল মিলিয়েই মানুষ। আপনার হয়তো রাতে ঘুমানোর জন্য চাই নিকষ অন্ধকার, কিন্তু সঙ্গীর অভ্যাস হয়তো ডিম লাইটের আলোয় ঘুমানো। বিছানা গোছানো, মশারি টাঙানো, আলমারি পরিচ্ছন্ন রাখার মতো ছোটখাটো বিষয়ও বিয়ের পর মহা ঝামেলা পাকিয়ে তুলতে পারে। আপনার সরলরেখার মতো চলতে থাকা দাম্পত্যে ছন্দপতন ঘটাতে পারে শব্দ করে ডালের বাটিতে চুমুক দেওয়ার মতো ছোট্ট কাজও। তাই ঘুমানোর সময় নাক ডাকেন কি না বা কথা বলতে বলতে নখ কাটার অভ্যাস আছে কি না, সেসবও আলোচনার টেবিলে তুলে আনুন। দুজনের অভ্যাস আর বদভ্যাসের সবটাই শুনে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিন জুটি গড়বেন কি না।
৭. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
কেউ কেউ নিজের সুখ-দুঃখের নানা ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিতে ভালোবাসেন। কেউ আবার একান্তে রাখতে চান এসব বিষয়। দুই ধরনের আচরণের পক্ষে দুজনেরই হয়তো শানদার যুক্তি আছে। তবে বিয়ে করার আগে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আপনার অবস্থান সঙ্গীকে পরিষ্কার করে তুলে ধরুন।
চাইলে একজন আরেকজনের আইডি দেখেও বোঝার চেষ্টা করতে পারেন। এ বিষয়ে অপরপক্ষের মতামতও শুনুন। শোনাটা জরুরি, কারণ আপনার সঙ্গীর যদি অনলাইন জগতে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে আপত্তি থাকে, তাহলে সেটা আপনি মেনে নিতে পারবেন কি না, বুঝে নিন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পরিবারের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে, যারা আপনাদের পোস্ট করা কোনো ছবি, ভিডিও বা মতামত নিয়ে অযথা বিতর্ক তুলতে পারে। তাদের কীভাবে সামলাবেন, সেটা নিজেরা ঠিক করে নিতে পারেন।
সূত্র: গার্ডিয়ান লাইফস্টাইল ও ফেমিনা