ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীরা কোনো বিপদে পড়লে ছুটে যান তিনি। কোনো নারী হয়তোবা বিদেশ থেকে ফিরেছেন, বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যেতে পারছেন না। হয়তো ফিরে আসা কোনো প্রবাসীর খাবার প্রয়োজন, খোঁজ যাবে তাঁর কাছে। তিনি আল-আমিন। চেনাজানা মহলে তাঁর পরিচয় নয়ন নামে। প্রবাসীদের কাছে তিনি স্রেফ ‘নয়ন ভাই’।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এই বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য যে তথ্যসেবাকেন্দ্র পরিচালনা করে, আল–আমিন সেটারই ব্যবস্থাপক। তাঁর সঙ্গে কাজ করেন একজন কাউন্সেলরসহ একদল স্বেচ্ছাসেবী।
করোনার এই সংকটকালে দেশে ফেরা প্রবাসীদের খাবার, চিকিৎসা, পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ যেকোনো সংকটে কাজ করেন তাঁরা। অবস্থাটা এখন এমন হয়েছে, বিমানবন্দরে মানসিক অসুস্থ বা ঠিকানাহীন কোনো কর্মী দেখলেই কল্যাণ ডেস্ক কিংবা বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ফোন দেয় আল–আমিনকে। এসব কারণেই জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি তাঁকে এ বছর ‘পরিবর্তনের রূপকার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক তাঁকে এই করোনাকালে মানবিক মানুষ হিসেবে ধন্যবাদপত্র দিয়েছে।
আল–আমিন জানালেন, গত চার বছরে ব্র্যাকের মাধ্যমে তাঁর সহায়তায় বিমানবন্দরে ১২ হাজার প্রবাসী কোনো না কোনো সেবা পেয়েছেন। শারীরিক অসুস্থ ৩০ কর্মীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছেন। মানসিক অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরা ঠিকানাহীন ৫৫ নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন পরিবারের কাছে। প্রবাসে মৃত ৩৩ কর্মীর মরদেহ দেশে আনতে সহায়তা করছেন। বিদেশে বিপদগ্রস্ত ৪০০ নারী-পুরুষকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে নিরাপদে দেশে আনতে কাজ করেছেন তিনি। তাঁরই তথ্যসহায়তায় বিভিন্ন জেলায় ব্র্যাকের রিইন্টিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার থেকে কাউন্সেলিং সেবা পেয়েছেন ৭৩৩ জন। আর্থিক সহায়তা পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অন্তত সাড়ে ৫০০ মানুষ।
আল-আমিন জানান, দেশে ফেরা কোনো কর্মীর ঠিকানা পাওয়া না গেলে অনেক সময় দূতাবাস তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি তখন ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবারগুলো খুঁজে বের করেন। নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগই তাঁদের অসহায়ত্বের কথা তাঁর কাছে বলেন। সব শুনে কার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা অফিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেন তিনি।
এমনও হয়, দিনে ১০০–১৫০টি ফোনকল ধরতে হয়। ফোনে এত কথা বলা, এতজনের সমস্যার কথা শোনা, এসবে বিরক্ত লাগে না? জবাবে আল-আমিন বলেন, ‘তাঁরা অসহায় বলেই তো আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি তাঁদের কষ্টটা বুঝি। কারণ, আমিও একদিন তাঁদের মতোই ছিলাম।’
আল-আমিনের বাড়ি রাজশাহী। বাবা কৃষক। মা গৃহিণী। ২০০৭ সালে এক প্রতিবেশী তাঁকে মালয়েশিয়ায় চাকরির আশা দেখান। একটি নামকরা ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি, বেতন ৩৫–৪০ হাজার টাকা। তাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর পরিবার জমি বিক্রি করে তাঁকে মালয়েশিয়া পাঠায়।
সরকারি সব নিয়ম মেনে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরই বুঝতে পারেন, তিনিসহ অন্যদের আসলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তামিল এক মালিকের অধীনে আল-আমিনদের পাহাড়ের জঙ্গল কাটতে হতো। সাপ, পিঁপড়া, ব্যাঙ, কেঁচো, জোঁকের অত্যাচার সহ্য করতে হতো। কাজ করতে না চাইলে নেমে আসত মালিকপক্ষের অত্যাচার।
অতিষ্ঠ হয়ে একসময় তাঁরা দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। ফলে মালিক তাঁদের ৩০০–৪০০ কর্মীকে এক গুদামঘরে বন্দী করে রাখেন। জানালা ভেঙে আল-আমিনসহ ১১০ জন পালিয়ে আশ্রয় নেন দূতাবাসে। পরে তাঁরা খালি হাতে দেশে ফিরতে সক্ষম হন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও
প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে অভিযোগ করে সেই রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে কিছু ক্ষতিপূরণও পান। এরপর শুরু হলো তাঁর নতুন পথচলা। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার কী কষ্ট, তা আল-আমিন জানেন। তাই তাঁদের সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসীদের যেকোনো সংকটের খবর পেলে সবার আগে ছুটে আসেন নয়ন ভাই। এ রকম মানুষদের নিয়েই আমরা অভিবাসীদের পাশে থাকতে চাই।’