বিন্নি ধানের বদলে ভুট্টার খই

ভুট্টার খইয়ের স্মার্ট নাম হলো ‘পপকর্ন’
ভুট্টার খইয়ের  স্মার্ট নাম হলো ‘পপকর্ন’

‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর,/ বসতে দেব পিঁড়ে,/ জলপান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিঁড়ে।/ শালি ধানের চিঁড়ে দেব,/ বিন্নি ধানের খই,/ বাড়ির কাছে কবরী কলা,/ গামছা-বাঁধা দই...।’ পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তো বিন্নি ধানের খই খেতে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই খই এখন পাওয়া যাবে কোথায়? বিন্নি ধানের চাষই প্রায় উঠে গেছে। খই অবশ্য অন্য ধানেরও হয়, তবে তা এখন আর খুব সহজলভ্য নয়।
হালকা খাবার হিসেবে চিড়া, মুড়ি, খইয়ের চল আমাদের দেশে আবহমানকাল থেকে। পল্লিকবি অতিথি আপ্যায়নের জন্য সেই জনপ্রিয় খাবারগুলোর কথাই তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেদিন আর এদিনের তফাত অনেক। বাঙালির চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাসেও অনেক বদল এসেছে। তবে চিড়া, মুড়ি অবশ্য বহাল তবিয়তেই আছে। বেকায়দা কেবল ধানের খইয়ের। এর চলও প্রায় উঠেই গেছে। চিড়া, মুড়ির মতো হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না বিন্নি ধানের খই। তবে তার বিকল্প হয়ে এসেছে ভুট্টার খই। এর স্মার্ট নাম হলো ‘পপকর্ন’।
পপকর্ন এখন বিকোচ্ছেও প্রচুর। ঢাকায় তো ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে গাড়ি থামলেই পলি প্যাকেটে ভরা পপকর্ন নিয়ে হাজির একাধিক বিক্রেতা। কেবল ঢাকায় নয়, দেশের সর্বত্রই এখন ভুট্টার খই দাম ও প্রাপ্যতার দিক থেকে অতিসুলভ। এর প্রধান কারণ অবশ্য ভুট্টা চাষের প্রসার। দেশের উত্তরাঞ্চলে এখন প্রচুর ভুট্টার চাষ হয়। নানাভাবে ব্যবহৃত হয় এই ভুট্টা। এর একটি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে পপকর্ন বা খই তৈরিতে।
ধানের খই তৈরির তুলনায় ভুট্টার খই তৈরি করা সহজ। ধানের খই ভাজতে হয় মেটে হাঁড়িতে বালু গরম করে তার ওপর ধান দিয়ে। খইয়ের সঙ্গে ধানের খোসাটিও যুক্ত থাকে। সেই খোসা ছাড়ানো বেশ ঝামেলার কাজ। সে তুলনায় ভুট্টার খইতে এসব ঝামেলা নেই। কড়াই বা এ ধরনের পাত্র গরম করে তাতে দু-এক ফোঁটা ভোজ্যতেল দিয়ে কয়েকটি ভুট্টা ছেড়ে দিলেই পট্পট শব্দে লাফিয়ে ওঠে খইগুলো। এখন তো দিব্যি পথের মোড়ে ঠেলাগাড়িতে ভুট্টার খই ভাজার দেশীয় প্রযুক্তির যন্ত্র বসিয়ে বস্তা বস্তা খই তৈরি করা হচ্ছে। পলি প্যাকেটের দাম মাত্র ১০ টাকা। সম্ভবত এই একটি পণ্যই সারা দেশে বিক্রি হয় অভিন্ন দামে।
ভুট্টার খই ও ধানের খই—এই দুটির গুণমান কেমন, সে সম্পর্কে জানালেন বারডেমের পুষ্টি বিভাগের প্রধান আখতারুন নাহার। তিনি বললেন, ‘ধানের খইয়ের বড় গুণ হলো, এটি খুব সহজে হজম হয়। সাধারণত যাদের হজমে সমস্যা বা বয়স্কদের মধ্যে যাঁদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তাদের আমরা দুধ দিয়ে খই খেতে পরামর্শ দিই। তবে ধানের খই এখন সব সময় পাওয়া যায় না। আবার দামও একটু বেশি। সে তুলনায় ভুট্টার খই অনেক সস্তা ও সহজলভ্য। ভুট্টার খইতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট আছে, আর আছে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন ‘এ’। ভুট্টার খইতে আঁশও আছে প্রচুর। হজম হয় ধীরে। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ে। পেটে অনেকক্ষণ থাকে। এ কারণে ডায়াবেটিসের রোগীদের আমরা সাধারণত ভুট্টার খই খেতে পরামর্শ দিই। তা ছাড়া বাচ্চাদের টিফিন হিসেবে ভুট্টার খই খুব ভালো। চিপসের বদলে এটি খেলে তাদের পুষ্টির অভাব মিটবে, আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও আশঙ্কা থাকবে না। সতর্কতা শুধু একটিই—যে তেলে ভাজা হচ্ছে, সেই তেলটি ভালো হওয়া দরকার। ভুট্টার খই ভাজতে তেল লাগে খুবই সামান্য, দু-এক ফোঁটা মাত্র। কাজেই যাঁরা বাণিজ্যিকভাবে এটি তৈরি করেন, তাঁরা যদি ভালো তেল ব্যবহার করেন, তবে ভুট্টার খই হবে খুবই নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বল্প দামের একটি খাবার।’
তাহলে জয়জয়কার হয়ে যাক ভুট্টার খইয়ের। আধুনিক কালের কবি নাহয় বিন্নি ধানের খইয়ের বদলে ভুট্টার খই দিয়েই আপ্যায়ন করবেন তাঁর অতিথিদের।