মাথায় কালো চুলের লহর পড়ছে এসে মুখে,
ঝাঁকে ঝাঁকে ভোমর যেন উড়ছে ফুলের বুকে।
পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘আলাপ’ কবিতার খুকির চুলের লহর মুখে এসে পড়লেও আজকের পৃথিবী চায় সব সময় ‘ফিটফাট’ থাকতে। সময়মতো চুল কাটানো চাই। চাই মনের মতো ‘হেয়ারকাট’। তাই প্রয়োজন অনুভব করলেই ছুটতে হয় সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্রে। এমনটাই হয়ে আসছিল করোনাকালের আগপর্যন্ত।
নব্বইয়ের দশকে মফস্বল শহরে মেয়েদের মাথার চুল কাটার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ ছিল খুব কম। মাতৃস্থানীয়রাই চুল কেটে দিতেন। এই প্রতিবেদকের ছোটবেলায়ও হয়েছে এমনটা। সেসব দিন পেরিয়ে পেশাদার চুল কাটার প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ অনেক বছর ধরে। মহামারি পরিস্থিতিতে আবার চুল কাটার চল মোড় নিল উল্টো দিকে। বাড়িতে নিজেরা চুল কাটছেন, সেই চল ফিরে এল আবার। অনভিজ্ঞ হাতে চুল কাটতে গিয়ে হতে পারে মজার অভিজ্ঞতা। হয়তো চুলের ‘কাট’ হলো না ঠিকঠাক, হয়ে গেল উঁচু–নিচু ঢেউ! কিংবা এক পাশ ঠিক, আর অন্য পাশ নিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
অভিজ্ঞতা না থাকলেও বাধ্য হয়েই অনেকে বাসায় চুল কাটছেন এখন। অন্তত তিন মাস পরপর চুল কাটার প্রয়োজন পড়ে। তবে বড় চুলও সুন্দর। খুব ছোট করে কাটতেই হবে, বিষয়টা এমন নয়। ‘গৃহবন্দী’ সময়ে বাড়িতে চুল কাটার চেয়ে চুলের যত্নে সময় বেশি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন মিউনিস ব্রাইডালের রূপবিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমিন। কেবল জরুরি হলেই বাড়িতে চুল কাটুন, নইলে পরীক্ষামূলকভাবে চুল কাটাছেঁড়া না করাই ভালো। শেষে পুরো অবয়বের ‘লুক’ নষ্ট হয়ে মন খারাপ হতে পারে।
বাড়িতে অনভিজ্ঞ হাতে কাটাকাটি করে আকৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সেবাকেন্দ্রেই আবার যেতে হতে পারে। বাড়িতে যতটুকু না কাটলেই নয়, কেবল ততটুকুই কাটুন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সময়-সুযোগমতো না হয় বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। তা ছাড়া সব ধরনের ‘কাট’ ভালোও হবে না বাড়িতে। চুলের ফিনিশিং, অর্থাৎ কাটার পর সব ঠিকঠাক করতে অভিজ্ঞ হাতের প্রয়োজন।
লম্বা চুল নিজে কাটতে গেলে মুশকিলে পড়তে হতে পারে। বাড়িতে অন্য কারও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। যেমন কেটে দেওয়া যায় মেয়ের চুল। তবে চুল কাটার ব্যাপারে তাঁর যেন আত্মবিশ্বাস থাকে অবশ্যই। ইন্টারনেট থেকে ভিডিও দেখে কিছুটা বুদ্ধি নিতে পারেন। তবে ভিডিওতে দেখানো পদ্ধতি নিজের চুলে প্রয়োগ করার আগে ভালোভাবে বুঝে নিন। নইলে মাঝপথে বিপন্ন বোধ করতে পারেন।
বাসায় চুল কাটতে গেলে কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। জেনে নেওয়া যাক তানজিমা শারমিনের কাছ থেকে—
চুলের তেল ও ময়লা অবশ্যই পরিষ্কার করে নিতে হবে চুল কাটার আগে। চুল কাটার আগে জট ছাড়িয়ে নিতে হবে।
চুল কাটার সময় চুল সেট করার ক্লিপ (সেটিং ক্লিপস), চিকন দাঁতের চিরুনি, চুল কাটার জন্য আলাদা কাঁচি কিংবা ট্রিমারের প্রয়োজন হয়ে থাকে। অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়, এমন কাঁচিতে চুল কাটলে চুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই চুল কাটার কাঁচি হতে হবে আলাদা। তা ছাড়া ধারালো কাঁচি না হলে চুলের যে জায়গা বরাবর কাটা হচ্ছে, সেখানে চাপ পড়ে। পানি ছিটানো বা স্প্রে করার প্রয়োজন হলে স্প্রে বোতল কাছে রাখুন, ট্রিমার ব্যবহার করলে অবশ্য চুল ভেজানোর প্রয়োজন হয় না।
চুল কাটার সময় কৃত্রিম তন্তুর (পলিয়েস্টার–জাতীয় কাপড়) তৈরি অ্যাপ্রোন পরে নেওয়া ভালো। না থাকলে সিল্ক বা জর্জেটের ওড়না ব্যবহার করতে পারেন। এমনকি তোয়ালেও জড়িয়ে নিন। এমন কাপড় নিতে হবে, যাতে চুল আটকে না থাকে।
ত্বক থেকে চুলের কাটা অংশ পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ ব্রাশ কিনতে পাওয়া যায়। তেমন ব্রাশ বাড়িতে না থাকলে ব্লাশ-অন করার ব্রাশ কাজে লাগাতে পারেন। নরম ব্রাশের পরিবর্তে কাপড় বা টিস্যুও কাজে লাগানো যেতে পারে। এগুলোর যেকোনোটি দিয়ে পাউডার ব্যবহার করে চুলের ক্ষুদ্র অংশ সরিয়ে ফেলা যায়। তাই এসবও রাখুন হাতের কাছে।
ঘরের এমন স্থানে চুল কাটবেন না, যাতে ঘরের কোণে বা আসবাবের আড়ালে চুল পড়ে থাকতে পারে। খোলামেলা স্থানে চুল কাটুন। তবে বারান্দায় নয়। হাওয়ায় চুল উড়ে যাবে। ঘরের মধ্যেও চুল কাটার সময় ফ্যান বন্ধ রাখতে হবে।
একবারে অনেকটা চুল কেটে না ফেলে অল্প অল্প করে কাটুন। তাহলে চুলের আকার ও আকৃতি—এর কোনোটি মনমতো না হলেও ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ থাকে।
ট্রিমার ব্যবহার করলে সেটিতে চুলের আকার অনুযায়ী নম্বর সেট করে নিতে পারেন। বারবার ট্রিমার চালিয়ে সঠিক আকার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব।
পনিটেইল করে চুল বেঁধে নিয়ে চুল কাটলে খোলার পর চুলের আলাদা আলাদা স্তর, অর্থাৎ ‘লেয়ার’ হবে। অভিজ্ঞতা থাকলে চুলের বিভিন্ন অংশ আলাদা করে নিয়ে লেয়ার বা স্তরে স্তরে কাটার চেষ্টা করা যেতে পারে।
ইংরেজি ‘ইউ’ বা ‘ভি’ আকৃতি করে চুল কাটতে চাইলে মাথার মাঝবরাবর সিঁথি করে নিয়ে ডান ও বাঁ পাশের চুল আলাদা করে কাঙ্ক্ষিত আকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাঙ্গেল (কোণ) অনুযায়ী কাঁচি চালাতে হবে। তাহলে দুই পাশ মিলিয়ে ইউ বা ভি আকৃতি (যেটির মতো কেটেছেন) তৈরি হবে। সমান করে চুল কাটতে চাইলেও একই পদ্ধতিতে চুল দুই ভাগ করে নিয়ে কাটুন। শুধু এ ক্ষেত্রে কোনাকুনি নয়, বরং সমান করে কাটতে হবে চুল। তবে অভিজ্ঞতা না থাকলে সমান করে চুল কাটা বেশ কঠিন।
ধাপে ধাপে আলাদা আকারের চুল (স্টেপ কাট) করতে চাইলে মাথার সব চুলকে তিনটি আলাদা অংশে ভাগ করে নিতে পারেন। যেখান থেকে চুলের ধাপ আলাদা করতে চাচ্ছেন, সেই বরাবর এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত চুলগুলোকে আলাদা করে নিন (পেছনের অংশ বা নিচের অংশ)। বাকি চুলগুলোকে ডান ও বাঁ দিকে ভাগ করে নিতে হবে। এরপর পছন্দমতো আকারে চুল কাটুন।
বাড়িতে যেহেতু চুল কাটার জন্য নির্ধারিত অ্যাপ্রোন থাকে না সচরাচর, তাই চুল কাটার পর গোসল করে নেওয়া ভালো। নইলে কাটা চুলের ক্ষুদ্র অংশের কারণে অস্বস্তি হতে পারে। অবশ্য চাইলে পাউডার ও নরম ব্রাশের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুল সরানোর জন্য। সবশেষে সেই জায়গা অবশ্যই পরিষ্কার করে নিন, যেখানে চুল কাটা হয়েছে।
বাড়িতে শিশুর চুল কাটার জন্যও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ট্রিমার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে শিশুর চুলে জটিল কোনো কাট দেওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। বরং সহজ কাট, যাতে শিশু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে, এমন কিছুই বেছে নিন।