বাবা, তোমাকে বলা হয়নি

বাবাকে কোলে নিতে পারা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

বাবাকে কোলে নিতে পারছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? বাবার পা দুটি নেই, তাই বাবাকে কোলে নিতে হচ্ছে, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?
বাবাকে কোলে নিতে পারছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? বাবার পা দুটি নেই, তাই বাবাকে কোলে নিতে হচ্ছে, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?

মা–বাবার সঙ্গে নানাবাড়ি যাচ্ছিলাম। নানাবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে। দীর্ঘ এই পথ বেশির ভাগ সময় পায়ে হেঁটে যেতে হতো। মা–বাবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমি প্রায়ই দৌড়াতাম। বছর পাঁচেক বয়স তখন, কতটুকুই আর হাঁটতে পারি।

একবার গ্রামের মেঠোপথ ধরে মা–বাবার সঙ্গে যেতে যেতে দেখা হলো এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি সাইকেলে করে বাজারে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, সাইকেলের পেছনে বসিয়ে আমাকে পৌঁছে দেবেন। বাবা-মাও রাজি হয়ে গেলেন। কিছুটা পথ হাঁটা থেকে বাঁচা গেল, ভেবে আমিও খুশিই হয়েছিলাম।

কিন্তু একটু পরই সব আনন্দ যেন বাতাসে মিশে গেল। সামান্য পথ যেতে না যেতেই আমার বাঁ পা ঢুকে গেল সাইকেলের পেছনের চাকায়। ব্যস, রক্তে ভেসে গেল ঘটনাস্থল। আমাকে কোলে নিয়ে বাবা ছুটলেন নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

এরপর নিজের পায়ে হাঁটতে পারিনি দীর্ঘ ছয় মাস। এই ছয় মাস বাবার কাঁধই ছিল আমার বাহন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। যতবার আমার পায়ের ড্রেসিং করাতে হতো, ততবারই বাবা কাঁধে করে নিয়ে যেতেন। এ ছাড়া কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা হলে চড়ে বসতাম বাবার কাঁধেই।

২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বাবার বাঁ পায়ে সামান্য ক্ষত দেখা দিল। সামান্য সেই ক্ষত ধীরে ধীরে ভয়ংকর রূপ নিল। যন্ত্রণায় তিনি দিন-রাত হাউমাউ করে কাঁদতেন। কোনো প্রকার ওষুধে যখন ক্ষত শুকাচ্ছিল না, তখন ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, পা কেটে ফেলতে হবে। সামান্য একটা ক্ষতর কারণে ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাবার বাঁ পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হলো।

কাটা পা শুকালো। বাবা সুস্থ হলো। আমরাও স্বস্তি পেলাম।

কিন্তু না।

এই সুস্থতা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, ডান পায়ের আঙুলগুলো গাছের ডালের মতো শুকিয়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ চিকিৎসায় কোনো উন্নতি না দেখে ডাক্তার আবারও জানান দিলেন, তার ডান পা-ও কেটে ফেলতে হবে। সবাই যেন বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। সিদ্ধান্ত হলো কেটে ফেলা হোক পা, তবু বাবা বেঁচে থাকুক।

২০২০ সালের মার্চ মাসে কাটা হলো ডান পা।

প্রথম পা কাটার পর বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারতেন। কিন্তু দ্বিতীয় পা কাটার পর হয়ে গেলেন বিছানাবন্দী। দ্বিতীয় পা কাটার পর যখন বাবাকে ড্রেসিং করাতে নিতে হতো, তখন আমার সৌভাগ্য হতো বাবাকে কোলে নেওয়ার।

বাবাকে কোলে নেওয়ার অনুভূতি একই সঙ্গে আনন্দের ও বেদনার। বাবাকে কোলে নিতে পারছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? বাবার পা দুটি নেই, তাই বাবাকে কোলে নিতে হচ্ছে, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?

হঠাৎ মা অসুস্থ হলেন, মারা গেলেন ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর। মায়ের শোকে কাতর আমরা বিছানায় মিশে যাওয়া বাবার বুকে মাথা রেখে কাঁদতেও পারিনি। বলতে পারিনি, ‘বাবা, মা নেই, আপনি থাকেন, আমাদের রাখেন আপনার বুকে।’ বাবার দেহ এতটাই নাজুক ছিল যে শক্ত করে বাবাকে ধরাও যেত না, ব্যথা পেতেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন হাউমাউ করে কাঁদতেও পারিনি কেউ।

আমাদের শোকের মধ্যে রেখেই বাবা মারা গেলেন মা মারা যাওয়ার মাত্র তিন দিনের মাথায়।

মায়ের শোকে কাতর থাকায় বাবাকে বলা হয়নি অনেক কিছুই। না বলা সব কথাই রয়ে গেল হৃদয়ে।

খুব ইচ্ছে করে এখন, একবার বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

একবার বলি, ‘বাবা আরেকটু আদর করো আমায়। আরেকটু।’