মোটরবাইক হাঁকিয়ে মাত্র ছয় দিনে ঘুরেছেন সমগ্র বাংলাদেশ। সেই বাইকেই পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে গেছেন নেপালের কাঠমান্ডু, ঘুরেছেন দেশটির আরও দুর্গম উপত্যকা। গত জুন মাসেই ঘুরে এলেন ভারতের দুর্গম এলাকা লাদাখ, সেও বাইক চালিয়ে। এই খ্যাপাটে বাইকারের নাম মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ। তাঁর ছুটে চলা নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।
সবুজ উপত্যকা তখনো মেঘের দখলে। অনতিদূরের পথও কুয়াশার মতো ঢেকে দিয়েছে সফেদ মেঘ। মোটরবাইকের গতি আরও কমিয়ে পেছনের সঙ্গীদের বললেন, ‘সাবধান, সামনের রাস্তাটুকু পাথরের দখলে!’ ১ জুলাই ঢাকায় বসে নিজের ল্যাপটপ কম্পিউটারের সেই দৃশ্যের ভিডিও দেখাচ্ছেন মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ। ভিডিও থামিয়ে বললেন, ‘এরপর দেখেন কী অপেক্ষা করছে!’
ভিডিওর বাকি অংশে আমরা দেখতে থাকি পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলা পথে রীতিমতো পাথরের স্তূপ। কোনোমতে বাইক নিয়ে এগিয়ে চলছেন চারজন বাইকার। কিছুক্ষণ পর ঝরনার শব্দ। বেইলি সেতুর পাশে সেই জলপতন, সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ঝরনাধারা। সেতুটি পার হতেই আটকে গেল বাইকের চাকা। আটকাল তো আটকালই। যতই চেষ্টা করা হলো চাকাজোড়া তোলার, ততই যেন নিচের দিকে দেবে যেতে থাকল। একসময় মনে হচ্ছিল নিচে থেকে কে যেন টেনে ধরেছে। সাদিকুল্লাহ একা যখন পারছিলেন না, দলের অন্যরাও এসে হাজির হলেন বাইক উদ্ধারে। দড়ি বের করে টানা হলো। যুক্ত হলেন পথচলতি স্থানীয় একজন অধিবাসী। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় এভাবেই একসময় উদ্ধার হলো বাইক।
নেপালের মুস্তাং উপত্যকায় যাওয়ার পথে এই খণ্ডচিত্রই বলে দেয় সেই মোটরবাইক যাত্রার রোমাঞ্চের কথা। ২০১৭ সালে নেপালের এই উপত্যকায় গিয়েছিলেন চারজন। ‘সে যাত্রায় আমরা কঠিন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। সেখান থেকে বাইক উদ্ধার করে আরেকটু সামনে যেতেই দেখি পাহাড়ি ঢল নেমেছে। একটা গাড়ি প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় যায় অবস্থা। অনেক কষ্টে সেখান থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করা হলো। আমরাও শরিক হলাম উদ্ধারকাজে।’ রোমাঞ্চের টানে ২০১৮ সালে মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ একাই গেছেন সেই পথে।
মোটরবাইক চালানোই যাঁর শখ, তাঁর আবার দুর্গম পথ কী। পেশায় তৈরি পোশাকশিল্পের উপকরণ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সাদিকুল্লাহ। শখের বাইকার। সময় পেলেই রোমাঞ্চের টানে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। কখনো ছুটে যান কক্সবাজার, কখনো পঞ্চগড়, কখনো দুর্গম আলীকদম-থানচি সড়ক, কখনো–বা কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। সেই যাত্রা বেশির ভাগই একাকী; আবার কখনো সঙ্গী হন স্ত্রী, কখনো নিজেই ভিড়ে যান রোমাঞ্চপ্রিয় মোটরবাইকচালকদের দলে। এভাবেই ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের সব কটি জেলা, বাইক হাঁকিয়েই চলে গেছেন ভারত আর নেপালের দুর্গম পার্বত্য এলাকায়।
প্রথম আলো কার্যালয়ে বসেই রোমাঞ্চকর বাইক চালানোর গল্প শোনাচ্ছিলেন। গল্পকে প্রাণসঞ্চার করছিল সঙ্গের ল্যাপটপে থাকা অসংখ্য ছবি আর ভিডিও। যেমন দেখালেন গত মাসে ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসা ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের লাদাখ ভ্রমণের ছবি। কুনলুন পর্বতশ্রেণি এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারা বেষ্টিত লাদাখ অঞ্চলে যাত্রা করেছিলেন কলকাতা থেকে মোটরবাইক ভাড়া করে। সাদিকুল্লাহ বললেন, ‘একসময় দেশ থেকেই মোটরবাইক নিয়ে চলে যেতাম। এখন সেটা করি না।’
তার ব্যাখ্যাও দিলেন সাদিকুল্লাহ, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ছুটির বিষয়টি আগে থেকে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তাই হুটহাট বেরোতে হয়। সে কারণে দেশ থেকে মোটরবাইক নিতে পারি না। মোটরবাইক নিতে অনেক ধাপ পেরোতে হয়, দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। একটা সময় সেসব করতে ইচ্ছে করত, এখন করে না।’
মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহর বেড়ে ওঠা দিনাজপুর শহরে। বাড়িতে মোটরবাইক ছিল। স্কুলে পড়ার সময় টুকটাক শেখা। কলেজে পড়ার সময় কয়েকজন বন্ধু মিলেই কিনে ফেলেন একটি মোটরসাইকেল। দিন-সময় ভাগ করে সেই মোটরবাইকই চালাতেন। এরপর ঢাকার জীবন শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে চাকরি নিলেন, কল্যাণপুর থেকে বনানীতে যেদিন প্রথম অফিসে যাবেন, সেদিনই বুঝলেন মোটরসাইকেল ছাড়া তিনি অচল! ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল কিনলেন। সেটা দিয়েই শুধু অফিস নয়, ছুটে যেতেন গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। ফেসবুকে পরিচিত হলেন খ্যাপাটে মোটারবাইকারদের গ্রুপ ‘বিডি রাইডার্স ক্লাব’–এর সঙ্গে। তাদের সঙ্গেই ভ্রমণের শুরু। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতেই একদিন বেরিয়ে পড়লেন দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা ভ্রমণে। ২০১৩ সালে ২৪ ঘণ্টার যাত্রায় কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পৌঁছালেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়।
রোমাঞ্চ যেন পেয়ে বসল মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহকে। হুটহাট বেরোতে থাকলেন বিভিন্ন দলীয় যাত্রায়। এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন ৬৪ জেলায় পা রাখার। সত্যি সত্যি একদিন বেরিয়ে পড়লেন পথে।
সমগ্র বাংলাদেশ ছয় দিন
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কয়েক দিন ধরে যাত্রাপথ আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্রটা সঙ্গে নিয়ে ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়লেন মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ। তাঁর লিফ্যান কেপিআর মোটরবাইকের চাকা ছয় দিনে দেশের ৬৪টি জেলার মাটি স্পর্শ করল। এত অল্প সময়ে সারা দেশ ঘোরা সম্ভব? মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ তাঁর রুটম্যাপ বের করলেন। সবিস্তার তাঁর ভ্রমণ তালিকাটা নিজের ফেসবুক পেজেও দিয়ে রেখেছেন। সেই সঙ্গে আছে কোন খাতে কত খরচ, সেই হিসাবও। সেই তালিকা দেখেই বললেন, ‘এই দেখুন, সময়ের হিসাব। আমার অফিস তখন নারায়ণগঞ্জ ছিল। ৬৪ জেলার চার জেলা (ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ) ১৫ ডিসেম্বর অফিসের ফাঁকে ৩ ঘণ্টায় শেষ করে রেখেছিলাম। আমার হিসাব ছিল, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা, তাই দিনে ১৫ জেলা হলে, ৬০টি জেলার জন্য বরাদ্দ চার দিন। তাই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম ১৬ ডিসেম্বর। ভোরবেলা বসুন্ধরা ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে সিলেটের দিকে।’
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে বিরতি নিয়েছিলেন বগুড়ায়।
পরদিন ভোরে আবার গাইবান্ধা হয়ে যাত্রা শুরু, সেদিন বিরতি নিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এভাবে পাঁচ দিনে ৬৪ জেলায় মোটরবাইক হাঁকিয়ে গেছেন সাদিকুল্লাহ। বলছিলেন, ‘সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। মানচিত্র দেখে হয়তো একরকম চিন্তা করছি, কিন্তু পথে নেমে দেখেছি উল্টো চিত্র! বরিশাল অঞ্চল নদীবেষ্টিত। নদীতে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়, এসব হিসাব তো মানচিত্র দেখে।’
২০ ডিসেম্বর যাত্রা শেষ হয়েছিল কক্সবাজারে গিয়ে। বাইক চালিয়েছেন ২ হাজার ৫৫৯ কিলোমিটার। ৮ হাজার ৭০০ টাকার জ্বালানি খরচ হয়েছে। সেই হিসাবও রেখেছেন ভ্রমণ কড়চায়।
কক্সবাজার থেকে কাঠমান্ডু
নেপালের দুর্গম পথে এ পর্যন্ত মোটরবাইক হাঁকিয়েছেন ছয়বার। তবে স্মৃতির পাতায় প্রথম যাত্রার কথাই বারবার উঁকি দেয় মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহর মনে। সেই যাত্রা ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। সঙ্গী ছিলেন আরেক বাইকচালক আবিদুর রাহমান।
কক্সবাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত এসে বিরতি নিতে হয়েছিল অনুমতিপত্রের। আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়েছিল আগেই, অপেক্ষা তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনাপত্তিপত্রের। সেই অনুমতিপত্র পাওয়ার কাহিনি যেন ভোগান্তির অপর নাম! তবু যেদিন মিলল, তার পরদিনই যশোরের বেনাপোল হয়ে ভারতের রাস্তায় ‘ঢাকা মেট্রো’ লেখা বাইক নিয়ে ছুটলেন দুজন। তারপর কলকাতা-আসানসোল-পাটনা-মুজাফফরপুর হয়ে নেপালের বীরগঞ্জ সীমান্ত।
‘নেপাল অভিবাসন কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের হেটোরায় এসে হোটেলে উঠেছিলাম। পুরোপুরি অচেনা রাস্তাটা বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে (এটা চিতোয়ান জাতীয় উদ্যান)। হেটোরা এসে দেখি উৎসবের আমেজ। মনে পড়ল সেদিনটা ২০১৬ সালের শেষ দিন। থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন শহরজুড়ে।’ বলেন সাদিকুল্লাহ।
২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল নতুন রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে। হেটোরা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার তিনটা রাস্তা। একটি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার আর বাকি দুটি যথাক্রমে ১২০ আর ৮০ কিলোমিটার। অনেকে নিষেধ করল ৮০ কিলোমিটার দুর্গম রাস্তাটা ব্যবহার না করতে। মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ বললেন, ‘নিষেধ করেছিল বলেই আলাদা ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল। আমরা বেরিয়ে পড়ি সেই পথে।’
কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই শুরু হলো পাহাড়ি পথ। আরও খানিকটা যাওয়ার পর শুরু হলো মাটি আর পাথরের পাহাড়ি রাস্তা। তবে ভেবেছিলেন রাস্তার বুঝি কাজ চলছে! কিন্তু এবড়োখেবড়ো সড়কই পাহাড়চূড়া দিয়ে চলে গেছে সামনের দিকে। যেখানে একটু এদিক–সেদিক হলেই গভীর খাদে পড়ার আশঙ্কা। সেই আশঙ্কা বুকে চেপেই কাঠমান্ডু পৌঁছেছিলেন মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহরা। ৫ হাজার কিলোমিটারের সে যাত্রায় একইভাবে ফিরেছিলেন ঢাকায়।
মোটরবাইকে ঘুরবেন মহাদেশ
মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহর বয়স এখন ৪০। কবীর সুমন গেয়েছেন, ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে’। তবে বয়সকে স্রেফ সংখ্যা হিসাবেই মানেন এই বাইকার। তাই তো তাঁর ভ্রমণ উপাখ্যান শোনানোর এক ফাঁকে স্বপ্নের কথাটিও জানিয়ে রাখলেন, ‘মোটরবাইকে মহাদেশ ঘোরার স্বপ্ন আমার।’ সেই
স্বপ্ন সত্যি হতে হয়তো শিগগিরই পূরণ হবে, তাঁর মতো এই প্রত্যাশা আমাদেরও।