>নোবেলজয়ী ব্রিটিশ প্রাণ রসায়নবিদ ও অনুপ্রাণ জীববিজ্ঞানী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস। বর্তমানে তিনি নিউ ইংল্যান্ড বায়োল্যাবসে কর্মরত আছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পেয়েছেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে। ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তিনি। তাঁর বক্তৃতাটি আজ থাকল স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য।
শুভ সকাল। মঞ্চে উপস্থিত সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। সেই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই স্নাতকদের। আজকের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বিশিষ্ট ব্যক্তি তোমরাই! কারণ আজ তোমরা নতুন জীবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছ। তাই আমার জীবন থেকে নেওয়া তিনটি শিক্ষার কথা তোমাদের জানাতে চাই।
প্রথমটি হলো ‘ভাগ্য’। যদি অতীতে ফিরে তাকাও, দেখবে জীবনে বহু ক্ষেত্রেই ভাগ্য তোমার সঙ্গে ছিল। তার মধ্যে একটি হতে পারে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া। কাজেই, যখন দেখবে ভাগ্য তোমার অনুকূলে, এর সদ্ব্যবহার করবে। এমনও হতে পারে, ভাগ্য তোমার জন্য সুপ্রসন্ন, কিন্তু তোমার বন্ধুর জন্য নয়। তা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। সবার জীবনেই একটা পর্যায়ে এসে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। তুমি জানো না, ভাগ্য তোমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। এভাবে একদিন এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে, যেখানে যাওয়ার কল্পনাও হয়তো তোমার ছিল না। অথচ তুমি আশাতীত সাফল্য অর্জন করে ফেলেছ।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ‘ব্যর্থতা’। সফলতার পেছনে ব্যর্থতারও একটা দারুণ ভূমিকা আছে। এই মুহূর্তে যে কাজটা তোমার ভালো লাগছে, সেটাকেই আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে চলবে না। আমি অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি, তারা নিজের নয়, পরিবারের পছন্দের বিষয়ে পড়ে। এমনকি তারা চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিজের চেয়ে পরিবারের মতামতকেই গুরুত্ব দেয়। এটা সব সময়ই যে অমঙ্গল বয়ে আনবে, তা নয়। তবু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় একটু থেমে ভেবে নেওয়া উচিত। তুমি কি আদৌ কাজটা করতে চাও, নাকি অন্য কেউ বলছে বলে করছ!
ধরো, তুমি একটা কাজ করছ; এর মধ্যে তোমার নতুন কোনো কাজ ভালো লেগে গেল, যার প্রতি তোমার আগ্রহ বেশি। তাহলে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করতেও দ্বিধা বোধ কোরো না। এমন মনোভাব আমার জীবনে সব সময় কল্যাণ বয়ে এনেছে। জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাগুলোর মধ্যে এটি একটি।
আমার বয়স যখন আট কি নয়, আমি তখন গণিতবিদ হতে চাইতাম। এরপর একটু বড় হতে না হতেই ঘাড়ে রসায়নের ভূত চাপল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন প্রায় পার করে দিলাম রসায়ন পড়েই। ফাইনাল ইয়ারের দিকে একটা বই পড়তে গিয়ে ঠিক করলাম, আমি অণুপ্রাণ জীববিজ্ঞানী হব। আর এই অণুপ্রাণ জীববিজ্ঞানকেই পরে আমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। ক্যারিয়ারের শুরুতে যা করেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা এসেছে। এর কারণ আমি কোনোটাই শুরু করে শেষ করিনি। জীবনে ব্যর্থতারও প্রয়োজন রয়েছে। যারা কোনো কিছুতেই ব্যর্থ হয়নি, তারা জীবন থেকে তেমন কিছুই শিখতে পারেনি। পৃথিবীর সব সফল উদ্যোক্তার দিকে তাকালে দেখবে, তাঁরা এক লাফেই সফলতার চূড়ায় পৌঁছাননি। জীবনের শুরুর দিকে দুই-তিনটা কোম্পানি খুলে শেষে গিয়ে হয়তো ভাগ্য ফিরেছে।
গবেষণার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আমরা গবেষকেরা শুরুতে যেটাই করি, তাতেই ব্যর্থ হই। এতে প্রমাণিত হয় যে, আমরা যে পথে এগোচ্ছি, তা সঠিক নয়। হয়তো প্রকৃতি আমাদের কিছু বলতে চাইছে। আমি যে আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছি, শুরুতে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলগুলো আশানুরূপ হচ্ছিল না। কারণ, আমরা প্রকৃতি সম্বন্ধে যে ধারণা নিয়ে এগোচ্ছিলাম, সেখানে গলদ ছিল। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েও আমরা দমে যাইনি; বরং চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি ভুলগুলোকে খুঁজে বের করার। আর তাতেই একদিন আমরা বিশাল এক আবিষ্কার করে ফেলেছি। জানতে পেরেছি, মানুষ আর ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর মাঝে রয়েছে বিস্তর তফাত। আবিষ্কার করেছি ইন্ট্রন, এক্সন আর স্প্লিট জিন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। এটা একটা বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল, যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
জগতের প্রায় সব বড় আবিষ্কারের আগে সেগুলো সম্বন্ধে কেউই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি। আর এখানেই আবার ভাগ্যের ভূমিকা চলে আসে। আমি ভাগ্যবান জীববিজ্ঞানের এমন একটা শাখা নিয়ে কাজ করতে পেরে, যেখানে আবিষ্কারের সুযোগ ছিল। আর পাঁচজন নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে কথা বললে দেখবে, তাঁরা কেউই নোবেল পুরস্কারের কথা ভেবে আবিষ্কারের বিষয়বস্তু খোঁজেননি। তাঁরা হয়তো একেবারে ভিন্ন কোনো কাজ করতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে দারুণ কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
তোমাদের জন্য আমার সর্বশেষ উপদেশ হলো, কোনো পেশা বেছে নেওয়ার আগে অবশ্যই ভেবে নেবে; শুধু তোমার বা পরিবারের জন্য নয়, গোটা মানবজাতির জন্য সেটা মঙ্গলকর কি না। এ রকম ভাবনা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে খুব দরকার। দেশের স্বার্থে ক্ষেত্রবিশেষে তোমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করা উচিত। এ দেশে আসার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রগতিশীল মনোভাব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি; যা আমাকে সমগ্র বিশ্বের সুন্দর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভাবতে আশাবাদী করেছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে জিএমও বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড অরগানিজম সম্বন্ধে তোমাদের আচরণ। পৃথিবীর গুটিকয় রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি যারা প্রথম জিএমওকে কৃষিকাজে ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছে। কৃষকেরা এখন উদ্ভিদের বংশগতির পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রচুর পরিমাণে উন্নতজাতের বেগুন চাষ করছেন। নতুন প্রজন্মেরও জিএমওর গুরুত্ব সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে এ দেশের অনেকাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এমন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা প্রয়োজন, যা প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে জিএমওই তোমাদের সহায়তা করতে পারে।
আজকাল বিশ্বে এমন অনেক কিছু ঘটছে যা মেনে নেওয়া যায় না। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মানতে নারাজ পৃথিবীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং শুরু হয়ে গেছে! অথচ এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী বাংলাদেশ। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ক্রমশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশকেই বহু সমস্যায় পড়তে হবে। নতুন প্রজন্ম হিসেবে এটা তোমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন তোমাদের রাজনীতিবিদেরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষতিকর পরিণতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। কারণ এটা তোমাদের দেশ। বিশ্ব যেন এটি মোকাবিলা করার জন্য সক্রিয় হয়—এ ব্যাপারে তোমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।
নিজেরা কর্মনিষ্ঠ হও। মনে রেখো, কর্মপরায়ণ হওয়া মানে এই নয় যে সব সময় তোমার নিজেকেই কাজটি করতে হবে। প্রভাবশালী কাউকে খুঁজে বের করো, যাঁর কথা লোকে শোনে। সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে তোমার পক্ষে আনো। তাঁকে দিয়ে কাজটি করাও। আগামী বিশ্ব শুধুই নতুন প্রজন্মের হাতে। আমাদের মতো বৃদ্ধের হাতে নয়।
আমি এখন ভাগ্য নিয়ে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের শোনাতে চাই। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা। যেদিন আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে দুটো বিমান ধ্বংস হয়েছিল। এর একটি প্লেনেই আমার ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। ফ্লাইটের দুই সপ্তাহ আগে মিটিংয়ের তারিখ এক দিন এগিয়ে গেল। তাই আমি এক দিন আগের প্লেনে টিকিট বুক করলাম। সেদিন পরিকল্পনা না বদলালে আজ আমি এখানে উপস্থিত থাকতে পারতাম না। মনে রাখবে, ভাগ্য সারা জীবনই তোমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মাঝেমধ্যে পেছনে ফিরে দেখবে, কীভাবে ভাগ্য আমাদের জীবনকে সাজিয়ে–গুছিয়ে চলেছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন