১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রেহাই দেওয়ার জন্য দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করে খন্দকার মোশতাক সরকার। এই ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সেই দায়মুক্তি আইন বাতিল করে, যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। ওই বছরের অক্টোবরে ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। পরের বছর ১৯৯৭ সালে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ১৯৯৮ সালে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে হত্যার দায়ে ১৫ জনের ফাঁসির রায় দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল।
এই মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দিতে উঠে আসে মোশতাকের আত্মীয় ঘাতক খন্দকার আবদুর রশীদসহ অন্যরা কবে, কখন, কীভাবে, কোথায় বসে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আর কোন কোন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতার যোগাযোগ হয়। কীভাবে তাঁরা নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের আগে বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন? সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান কী বলেছিলেন? তাঁর ভূমিকা কী ছিল? বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে বঙ্গভবনে মোশতাক কী বলেছিলেন?
এ মামলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ও আসামির আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য তুলে ধরা হলো, যাতে পাঠকেরা বুঝতে পারেন তখনকার ঘটনাপ্রবাহ।
সাক্ষী লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ (তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন):
‘আমরা সিনিয়র অফিসাররা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে টেনিস কোর্টে নিয়মিত টেনিস খেলতাম। ১৪ আগস্ট বিকেলে জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল মামুন, কর্নেল খোরশেদ ও আমি টেনিস খেলছিলাম। তখন আমি চাকরিচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। প্রকৃতপক্ষে এদের দুজনকে আগস্টের প্রথম থেকে এভাবে টেনিস কোর্টের আশপাশে দেখতে পাই, যা আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। কারণ তারা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। একই দিন জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলেন, “এরা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার, এরা কেন টেনিস খেলতে আসে?” আমাকে তিনি বলেন, “এদের মানা করে দেবেন, এখানে যেন এরা না আসে।” খেলা শেষে আমি মেজর নূরকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আসো?” জবাবে নূর জানায়, জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে তারা এখানে খেলতে আসে।’
সাক্ষী মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ (ডিজিএফআই ঢাকা ডিটার্চমেন্টের ওসি ছিলেন):
‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কিছুদিন আগে ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার রউফ তাঁকে বলেছিলেন, মেজর ডালিম, মেজর নূরসহ কিছুসংখ্যক অফিসার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। ডিজিএফআইয়ের ডিজি তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন।’
‘আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখ বঙ্গবন্ধুর একটি কর্মসূচি পাই। ডিজিএফআই থেকে আমাকে বঙ্গবন্ধুর পারসোনাল বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু যেখানে যাবেন, সেখানে সাদাপোশাকের সৈনিকদের পোস্টিং দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। ১৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।’
‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গ্যারেজের করিডরে একটি গাড়ির মধ্যে বুলেটবিদ্ধ কর্নেল জামিলের লাশ দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিচতলায় রিসেপশন টেলিফোন রুমে শেখ কামাল, শেখ নাসের এবং অপর একজনের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখতে পাই। আমরা ডিজিএফআইয়ের ক্যামেরা দিয়ে নিচতলার লাশের ছবি তুলি। সিঁড়ির ওপর বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই। দেখে মনে হচ্ছিল, একজন নিষ্পাপ শিশু ঘুমিয়ে আছে। আমার মনে হলো, মৃত্যু তাহাকে পরাজিত করতে পারে নাই।’
‘আমি সেদিন বঙ্গভবনে যাই। সন্ধ্যায় দেখতে পাই রাষ্ট্রপতির রুমে বসে খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জেনারেল সফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, এয়ার এবং নেভি চিফদ্বয়, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর আজিজ পাশা। আলোচনারত এই সময় বিভিন্ন দেশের রেডিও মনিটরিং নিউজগুলি খন্দকার মোশতাকের কাছে এনে দেওয়া হয়। তিনি সবাইকে পড়ে শোনান যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আধঘণ্টা হতে এক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান সরকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। এ সংবাদ শোনার পর মেজর ফারুক, মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমকে উল্লসিত ও গৌরবান্বিত মনে হচ্ছিল।’
সাক্ষী অধ্যাপক খুরশিদ আলম (কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন):
‘১৯৭৫ সালের মে বা জুনে খন্দকার মোশতাকের গ্রামের বাড়ি এলাকায় একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট দেওয়া হয়। খন্দকার মোশতাক সাহেবের আমন্ত্রণে শিক্ষা মন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এমপি উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষে মোশতাক সাহেবের চা চক্রে যোগদান করি। চা পানের সময় খন্দকার মোশতাক সাহেব, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পলিসি কর্মসূচির সমালোচনা করেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সময়ে খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পলিসির ব্যাপারে বিদ্বেষমূলকভাবে কটাক্ষ করতে দেখা যায়। তারপর জুন-জুলাইয়ে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সম্মেলন হয়। সেখানে মোশতাক সাহেব, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং আমি নিজে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আরও কয়েকজন সামরিক অফিসার আসেন। সম্মেলন শেষে খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, মেজর রশীদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার খন্দকার মোশতাকের বাসায় চলে যান।’
সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়েত জামিল (ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার):
শাফায়েত জামিল বলেন ‘পারিবারিক কলহের জের হিসেবে মেজর ডালিম গাজী গোলাম মোস্তফার ঢাকার বাড়িতে একজন সহযোগী অফিসার, সেনাসদস্যসহ হানা দিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে লাঞ্ছিত করে। মেজর ডালিমের উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ ও সেনা আইন ভঙ্গের জন্য তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর জের হিসেবে মেজর নূর চৌধুরী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে। তারপর মেজর নূরকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। চাকরিচ্যুতির কারণে তারা উভয় বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল।’
‘আমি দ্রুত ইউনিফরম পরে মেজর হাফেজসহ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দিই। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যাই। তাঁকে শেভরত অবস্থায় পাই। আমার নিকট হতে ঘটনা শোনার পর তিনি (জিয়া) বললেন, ‘স্যো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ কিলড; ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপ হোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’
‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ সতীর্থ ছিলেন। জিয়াউর রহমান সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তাঁকে চিফ অব স্টাফের পদ দেওয়া হয় নাই। এতে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না।’
মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ (সেনাপ্রধান ছিলেন):
‘১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আমাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি এই নিয়োগের প্রতিবাদ করি। কারণ জিয়াউর রহমান ও আমার একই রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি বাই নম্বর-এ আমার আগে ছিলেন অর্থাৎ আমার ১ নম্বর সিনিয়র ছিলেন। আমি মেজর রবকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এই প্রতিবাদ জানাই। প্রতিবাদ দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় দুই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমার সব কথা শোনার পর বললেন, ‘তোমার সব কথা শুনেছি। দেয়ার ইজ সামথিং কলড পলিটিক্যাল ডিসিশন।’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘ফ্রম টুডে অ্যান্ড নাউ অনওয়ার্ডস; আই অ্যাম এ ভিকটিম অব সারকামাস্টেন্স।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমরা বড় বড় কথা বলো, যাও কাল থেকে তুমি জেনারেল ওসমানীর নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে নাও।’ জিয়াউর রহমানকে টেলিফোনে আমার দায়িত্ব পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত জানাই। জিয়া তখন বলেন, ‘ওকে সফিউল্লাহ। গুড বাই।’
‘আমি যখনই কোনো অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ব্যবস্থা নিয়েছি, তখন ওই সব অফিসার জেনারেল জিয়ার নিকট শেল্টার নিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার বিষয়ে আদালতকে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।” প্রতি উত্তরে আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?’ আমি যখন জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করি তখন তাঁদের তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসতে বলি। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে তাঁরা আমার বাসায় এসে পড়ে। জিয়া ইউনিফরমড ও শেভড। খালেদ মোশাররফ নাইট ড্রেসে নিজের গাড়িতে আসে।
‘স্বাধীনতার পর দেশের আইন শৃঙ্খলার কিছু অবনতি ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। কাজেই অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব আর্মিকে দেওয়া হতো। ওই সময় আমি এই দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম। সেটাকে লক্ষ্য রেখে পুলিশকে শক্তিশালী করার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনী সম্বন্ধে কিছু মহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বলে যে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে গঠিত হয় এবং এ মর্মে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। রক্ষীবাহিনীকে কার্যকর করার জন্য পার্লামেন্টে আইন পাস হয়, যাতে রক্ষীবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে অপপ্রচার হয় এবং সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দেয়।’
‘বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সূর্যসেনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওই দিন বিকেলে মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়।’
মেজর জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমান (তৎকালীন বিডিআরের ডিরেক্টর ছিলেন):
‘জেনারেল জিয়া নম্বরের ভিত্তিতে জেনারেল সফিউল্লাহর সিনিয়র থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সেনাপ্রধান না করায় কিছু আর্মি অফিসার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তখন এই সমস্যা দূর করার জন্য শুনিয়াছি, জেনারেল জিয়াকে আর্মি হতে অবসর দিয়ে অ্যাম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত) হিসেবে বিদেশে পাঠাই দেবে। মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের পর একপর্যায়ে মেজর রশিদ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার মনে হলো, মেজর রশিদ একটু গর্ব করে বলেন, “ইনি আমার স্ত্রী। আমরা যা করেছি তার প্রধান প্ল্যানার আমার স্ত্রী।”’
এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার (বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন):
‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে ফোন করে বলেন, “শুনেছেন বঙ্গবন্ধু অ্যাসাসিনেটেড হয়েছেন।” আমি হতবাক হয়ে যাই। জিজ্ঞাসা করি, আর ইউ শিওর? তিনি বলেন, “হ্যাঁ।” আমি এখনই আসছি বলে টেলিফোন রেখে দিই। অতঃপর কেবল একটি প্যান্ট ও শার্ট পরে হেঁটে জেনারেল সফিউল্লাহর বাসায় যাই। সেখানে সফিউল্লাহ ছাড়া জেনারেল জিয়াকে ইউনিফরম পরা অবস্থায় দেখি। দুই-এক মিনিটের মধ্যে খালেদ মোশাররফ সেখানে ক্যাজুয়াল ড্রেসে আসেন। তাৎক্ষণিক আলোচনায় জানতে পারি, মাত্র কয়েকজন আর্মি অফিসারের দ্বারা এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।’
‘একটি জিপে করে মেজর রশীদ ও ডালিম জেনারেল সফিউল্লাহকে এসকর্ট করে রেডিও স্টেশনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরাও পেছনে পেছনে রেডিও স্টেশনে যাই। আমাদের পেছনে সশস্ত্র আর্মির গাড়ি ছিল। রেডিও স্টেশনে গেলে আমাদের যে ঘরে নিয়ে যায় সেই ঘরে খন্দকার মোশতাক এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে বসা দেখি। সেখানে মেজর নূর, মেজর ডালিম, মেজর রশীদ, মেজর ফারুক ও মেজর শাহরিয়ারকেও দেখি। কে একজন বলল, তিন বাহিনীপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। এই আনুগত্য পত্রটি তাহের উদ্দিন ঠাকুর আমাদের সামনে নিয়ে আসেন এবং এই আনুগত্যপত্রটি আমাদের পড়তে দেওয়া হয়। আমরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওই আনুগত্যপত্রটি পড়তে বাধ্য হই। তারপর রেডিওর কর্মচারীগণ আমাদের কণ্ঠে পড়া আনুগত্য ঘোষণাটি রেকর্ড করে।’
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম খান (তৎকালীন ডিএসবির প্রটেকশন ফোর্স হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাসার গার্ডদের চার্জে ছিলেন):
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘১৪ আগস্ট দিবাগত রাত অনুমান ১টার সময় আমি এবং একজন পুলিশ সার্জেন্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিচের তলার বৈঠকখানায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর পিএ কাম রিসেপশনিস্ট মুহিতুল ইসলাম সেখানে ছিলেন। ভোর অনুমান ৫টার সময় দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর গলার আওয়াজ শুনতে পাই। তিনি তাড়াতাড়ি নিচে আসছেন অনুমান করতে পারি। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে নিচে নেমে রিসেপশনিস্ট রুমে গিয়ে টেলিফোনে আলাপের চেষ্টা করেন। এ সময় হঠাৎ পূর্ব-দক্ষিণ থেকে এক ঝাঁক গুলি রিসেপশনিস্ট কক্ষের জানালার কাচ ভেঙে ফেলে। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, “এত ফায়ারিং কিসের?” আমি বললাম, বাইরে ঝামেলা হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু এবং আমি দেখতে পেলাম, কালো এবং খাকি পোশাকধারী কিছু আর্মি পূর্ব-দক্ষিণ এবং পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে ক্রলিং করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। এটা দেখে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় তলায় চলে যান। পরপরই বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল নিচতলায় বৈঠকখানার সামনের বারান্দায় এসে আমাকে বলে, “আর্মি আসিয়াছে কী?” আমি বললাম, মনে হয় আর্মি আসিয়াছে। তখন শেখ কামাল উৎফুল্ল হয়ে বলল, “আর্মি ভাইয়েরা কারা আসিয়াছেন, ভেতরে আসেন।” দ্বিতীয়বারও একই কথা উচ্চারণ করেন। কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। পরে হঠাৎ ৫-৬ জন কালো এবং খাকি পোশাকধারী আর্মি গেট ধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে আগাইতে থাকে। আমাদের লক্ষ্য করে বলল, “হ্যান্ডস আপ।” তখন আমি এবং পুলিশ সার্জেন্ট হ্যান্ডস আপ করি। দরজার কাছে পিএ মুহিতুল ইসলাম দাঁড়ানো ছিলেন। শেখ কামাল কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমি শেখের ছেলে কামাল।” শেখ কামাল হ্যান্ডস আপ করার সঙ্গে সঙ্গে কালো পোশাকধারীর পেছনে থাকা আর্মি গুলি করে। গুলি খেয়ে কামাল বলে, ‘ওরে বাবা।” এরপর রিসেপশনিস্ট রুমে গিয়ে পড়ে যায়।’
সাক্ষী বাদী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন):
‘১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত আনুমানিক ৮ থেকে ৯টার মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাড়িতে আসেন। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ওঠায়। বলেন, “রাষ্ট্রপতি আপনাকে টেলিফোনে ডাকছে।” তখনো ভোর আনুমানিক সাড়ে ৪টা-৫টা হবে। চারদিকে ফরসা হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে টেলিফোন ধরি। রাষ্ট্রপতি দোতলা থেকে টেলিফোনে বলেন, “সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন লাগা।” বঙ্গবন্ধু দোতলা হতে নিচে নেমে আমার অফিসকক্ষে আসেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগাতে বললাম, লাগালি না?” আমি তখন বলি, পুলিশ কন্ট্রোল রুমকে চেষ্টা করছি, পাইতেছি না। আমি গণভবন এক্সচেঞ্জ ধরিয়াছি কিন্তু কথার কোনো উত্তর দিতেছে না। আমি তখন হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করতে ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত হতে টেলিফোনের রিসিভার নেন এবং বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’’। ঠিক তখনই এক ঝাঁক গুলি আমার অফিসের দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙে কক্ষের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু আমার টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং আমার হাত ধরে টেনে শুতে বলেন। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ান। কাজের ছেলে আবদুল ওরফে সেলিম ওপর থেকে বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে আসেন। বারান্দায় এসে বলেন, “আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি হইতেছে, তোমরা কী করো।”’
‘ওপর থেকে কাজের ছেলে রমা ওরফে রহমান ওরফে আবদুর রহমান ও শেখ রাসেলকে আর্মিরা নিয়ে আসে। শিশু রাসেল প্রথমে রমাকে পরে আমাকে জড়াইয়া ধরে এবং বলে, “ভাইয়া আমাকে মারবে নাতো?” আমার ধারণা ছিল ঘাতকেরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না। সেই ধারণাতে আমি তাঁকে বলি, না, ভাইয়া তোমাকে মারিবে না। একজন খাকি পোশাকধারী আর্মি আমার কাছ হতে শিশু রাসেলকে জোর করে ছাড়িয়া নেয়। রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে মায়ের কাছে নিবে বলে দোতলায় নিয়ে যায়। এরপর গুলি শুনি। এ সময় গেটে অবস্থানরত মেজর বজলুল হুদাকে মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞাসা করেন, তখন মেজর বজলুল হুদা বলেন, “অল আর ফিনিশড।”’
ঘাতক লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের জবানবন্দি:
‘আমি যখন ১৯৭৩ সালে কুমিল্লাতে কর্মরত ছিলাম, সেই সময় মেজর শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর আজিজ পাশা প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে কুমিল্লায় কর্মরত ছিল। তখন থেকে তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই সময় ঢাকাতে মেজর ডালিমের এক আত্মীয়ের পারিবারিক অনুষ্ঠানে ডালিমের স্ত্রীসহ কয়েকজন লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ল্যান্সার ইউনিটের ও ২ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কিছু অফিসার ও অন্যান্য র্যাংকের কিছু সদস্য আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি আক্রমণ ও তছনছ করে। ওই সময় প্রায় মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা আমার ব্যবসাকেন্দ্রে আসত এবং আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ মুজিব ও তাঁর নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে সমালোচনা করতাম। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ দেশে ফিরে আসে। মেজর ডালিম তার সাহায্য কামনা করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলে কারযোগে খন্দকার আবদুর রশীদ ও মেজর নূর আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আসে। সেখান থেকে তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের বাসায় যায়।
ঘাতক লে কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের জবানবন্দি:
‘১৯৭৪ সালের শেষের দিকে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় আমি কাজ করতে গেলে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানও জানতেন। তিনি কোনো অ্যাকশন নিতেন না, যার ফলে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আমার বীতশ্রদ্ধ ভাব জন্মে। ওই সময় লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা গাজী গোলাম মোস্তাফার ছেলের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের কতক অফিসার ও জওয়ানেরা গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি তছনছ করে। তাতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে মেজর ডালিম, মেজর নূর ও আরও কয়েকজনের চাকরি চলে যায়। ওই সময় তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমার বাসায় হেঁটে আসতেন। তিনি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং একসময় বলছিলেন, “তোমরা ট্যাংক টুংক ছাড়া দেশের আর খবরাখবর রাখো কী?” আমি বলি, দেখতেছিতো দেশে অনেক উল্টা-সিধা কাজ চলছে। আলাপের মাধ্যমে আমাকে ইন্সটিগেট করে বলেছিলেন, “দেশ বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করা দরকার।” ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে দেশে বাকশাল গঠন হয়। জেলায় জেলায় গভর্নর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছিল। এ নিয়ে মেজর রশীদের সঙ্গে দেশের অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা থাকায় সিদ্ধান্ত হয় যে, একমাত্র শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টে এনে তাঁকে দিয়ে পরিবর্তন করা ছাড়া দেশে পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। রশীদের বাসায় এসব আলোচনাকালে তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রশীদও উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলাপ করার সিদ্ধান্ত হয়। সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাত্রে তার বাসায় আমি যাই। দেশের পরিস্থিতি খারাপ বলে তার সঙ্গে আলোচনা হয়। সাজেশন চাইলে তিনি বলেন, “আমি কী করতে পারি, তোমরা করতে পারলে কিছু করো।” পরে আমি রশীদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাঁকে জানাই। রশীদ তখন বলে, “এ বিষয় নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা পলিটিক্যাল ব্যাপার। আমি ডিল করব।” রশীদ পরে জিয়া ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খন্দকার আবদুর রশীদ পরিকল্পনা মোতাবেক পলিটিক্যাল যোগাযোগ হিসেবে তাঁর আত্মীয় তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। মেজর রশিদ, ডালিম ও খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আলোচনা করে যে বাকশালের পতন ঘটাতে হবে এবং প্রয়োজনে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে হবে, নইলে দেশ ও জাতি বাঁচবে না। যৌক্তিকভাবে আমিও ধারণাকে সমর্থন করি। খন্দকার রশীদ জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও আমাদের সমর্থন দেবে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে মিলিটারি ফার্মে নাইট ট্রেনিংয়ের সময় কো-অর্ডিনেশন মিটিং করে ১৫ আগস্ট ভোরে চূড়ান্ত অ্যাকশনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ আগস্ট ঘটনার পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয়ে সাইফুর রহমানের বাড়িতে মিটিং হয়। জিয়া, রশিদ ও সাইফুর রহমান মিটিং করেন। পরে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হবে, সাইফুর ও রশীদ মন্ত্রী হবে, ওই উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়।
ঘাতক লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদের স্ত্রী ও আসামি জোবায়দা রশীদের জবানবন্দি:
‘পাকিস্তানফেরত অফিসারগণ দেশে আসার সময় এক র্যাংক বেশি বৃদ্ধি করে নেয়। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী গঠন করে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়াতেও আর্মির অফিসারদের মধ্যে সমালোচনা হয়। এসব বিষয় ফারুকের (ঘাতক) কাছে শুনি। মেজর ফারুক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করত ছোটবেলা থেকেই। তিনি জিয়ার পূর্বপরিচিত ছিলেন। একদিন রাতে মেজর ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। জিয়া নাকি বলে, “ইট ইজ এ সাকসেস দেন কাম টু মি। ইফ ইট ইজ অ্যা ফেইলার দেন ডু নট ইনভলব মি। শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়।” এর কদিন পর মেজর ফারুক আমার বাসায় এসে রশীদকে বলে যে, জিয়া বলেছে, “রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যে দায়িত্ব নিতে পারবে।” সে মোতাবেক রশীদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগামসি লেনের বাসায়। ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়াউর রহমান রশীদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল যাতে তাঁকে চিফ অব আর্মি করা হয়। ১৬ অথবা ১৭ তারিখ প্রাক্তন মন্ত্রী সাইফুর রহমানের গুলশানের বাসায় সাইফুর রহমান, আমার স্বামী ও জিয়ার উপস্থিতিতে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয় ঠিক হয়।
আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর (বঙ্গবন্ধুর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী):
‘১৯৭৪ সালে বন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে গেলে এবং কৃত্রিম খাদ্য সংকটের ফলে সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশটির জন্য সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হতে পারে। এ সুযোগে কিছু রাজনীতিবিদ এবং সামগ্রিক কিছু সদস্য একযোগে একটি পরিকল্পনা ১৯৭৫ সালে শাসনতন্ত্র সংশোধনপূর্বক বাকশাল গঠন, গভর্নরপদ্ধতি চালুর কারণে কিছু চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তার মধ্যে হতাশা বিরাজ করছিল। ১৯৭৫ সালের মে বা জুনের প্রথম দিকে ঢাকার গাজীপুর সালনা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মোশতাক সাহেব তাদের সংবাদমন্ত্রী সামসুল হক সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সালনাতে মোশতাক সাহেব সেনা অফিসারদের জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাদের আন্দোলনের অবস্থা কী?” জবাবে তারা জানায় যে, “বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমরা তাঁর প্রতিনিধি।” ১৯৭৫ সালের জুনে দাউদকান্দির মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সেনা অফিসারদের মধ্যে মেজর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুক যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে পৌঁছাই। খন্দকার মোশতাক বলেন, এ সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া দুইবার এসেছিলেন। সে এবং তাহার লোকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করায় খন্দকার মোশতাক জানায় যে, বলপূর্বক মত বদলাইতে চায়, প্রয়োজনবোধে যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত। খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানান যে, তিন তার মতামত দিয়েছেন। কারণ এ ছাড়া অন্য আর কাজ কিছু নাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল অনুমান ৬টার সময় খাদ্যমন্ত্রী টেলিফোনে আমার কাছে জানতে চান যে, গুলির আওয়াজ শুনেছি কী না, আমি না বলে জানাই। পরে আমাকে পুনরায় টেলিফোনে রেডিও শুনতে বলে। রেডিওতে শুনি মেজর ডালিমের ঘোষণা, “শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।” বুঝলাম, তাঁদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর খন্দকার মোশতাক টেলিফোন করে আমাকে রেডিও স্টেশনে আসতে বলে। সাঁজোয়া বাহিনীর পাহারায় রেডিও স্টেশনে আসি।’
নোট: খুনি খন্দকার আবদুর রশীদের ভায়রা খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান