বন্ধু যখন ক্যানটিন বয়

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যানটিনে খাবার পরিবেশন করছেন প্রথম আলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সভার বন্ধুরা
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যানটিনে খাবার পরিবেশন করছেন প্রথম আলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সভার বন্ধুরা

আপনি যে কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন বা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, সেখানকার ক্যানটিনের কর্মচারী ঠিকমতো খেতে পারছেন তো!

আপনি কখনো কি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন বয়কে বসিয়ে রেখে নিজে তার কাজগুলো করে দিয়েছেন? কখনো তাকে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন? তার সঙ্গে এক সুরে গলা মিলিয়ে গান গেয়েছেন?

হয়তো খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে! মনে হচ্ছে কোনো কল্পকাহিনি? কিন্তু ২৫ এপ্রিল, বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা এই কাজটি করেছেন। এটা কোনো সিনেমা বা কাহিনিতে নয়, বরং বাস্তবে। সব মিলিয়ে ২০ জন বন্ধু দুপুর ১২টা থেকে শুরু করে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের তিনটি ক্যানটিনের কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে খাবারের অর্ডার নেওয়া, ক্যানটিনের পরিচ্ছন্নতা ও যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাজ শেষে ক্যানটিনের সব কর্মচারীকে পাশে বসিয়ে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা।

সব বন্ধু যখন খাবার পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত, তখন ক্যানটিনের ম্যানেজারসহ অন্য কর্মচারীরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মোট তিনটি ক্যানটিন আছে। হলের প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন আবাসিক ছাত্রের খাবার রান্না হয় এই তিন ক্যানটিনে। যেগুলোতে তিনজন ম্যানেজারসহ সব মিলিয়ে ৫০ জন কর্মচারী আছেন, যাঁদের মধ্যে ছয়জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাঁরা সবাই সপ্তাহের সব দিন সকাল ৭টা থেকে রাতের ১১টা পর্যন্ত কাজ করেন। দুই ঈদ মিলিয়ে ১৪ দিনের বন্ধ ছাড়া সারা বছর তাঁদের কোনো ছুটি নেই।

অর্থাৎ বলতে গেলে পুরো বছরই ঘুম থেকে উঠেই তাঁরা কাজে নেমে পড়েন এবং মধ্যরাত অবধি চলে সেই কাজ।

তাঁদের এত পরিশ্রম ও ব্যস্ততার মাঝে সামান্য একটু স্বস্তি ছিল এই মহতী উদ্যোগ। হলের প্রধান ভবনের ক্যানটিনের বর্তমান কর্মরত ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে এই হলে ক্যানটিনের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু কখনো এমন উদ্যোগ আগে কেউ নেয়নি। বন্ধুসভার এই কাজ দেখে তাঁর খুব ভালো লাগছে বলে মন্তব্য করেন। ভবিষ্যতে আরও এমন উদ্যোগ নেওয়া হোক, সেটাই তিনি চান।

অন্য এক ক্যানটিনের পাশে অবস্থিত বারান্দায় বসে ১১-১২ বছরের একটি বালক অবাক দৃষ্টিতে বন্ধুসভার সদস্যদের কাজ করা দেখছিল। তার ভাষ্যমতে, গত দুই বছরের কর্মজীবনে কখনো দুপুরের খাওয়ার সময় সে এভাবে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়নি। বয়সে ছোট বলে তার কাজ ছিল টেবিল পরিষ্কার করা ও ছোটখাটো হুকুম পালন করা। কিন্তু এই প্রথম তার তেমন কোনো কাজ করতে হচ্ছে না। এতে সে অনেক আনন্দিত।

২৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা ক্যানটিন বয়ের কাজ করেছেন। ছবি: কবির হোসেন

অপর এক ক্যানটিনের কর্মচারী সোহেল জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা কাজে তাঁদের ব্যস্ত থাকতে হয়। সে জন্য ঠিক সময় খাওয়া-গোসল হয় না। কিন্তু সেদিন তিনি অনেকটাই নিজের মতো করে বিশ্রাম ও সময়মতো খাওয়ার সুযোগ পান। তাঁর দাবি হলো যদি সব সময় হলের শিক্ষার্থীরা টুকটাক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তবে তাঁদের কাজ আরও সহজ হবে।

সর্বোপরি হলের ক্যানটিনে কর্মরত সব কর্মচারী অনেক বেশি আনন্দিত ছিলেন। তাঁদের সবারই ইচ্ছা ও দাবি ছিল এমন সাহায্য ভবিষ্যতে আরও পাওয়ার। হলের এতগুলো আবাসিক ছাত্রের মধ্যে এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বন্ধুসভার এই অসাধারণ উদ্যোগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক আল আমিন শেখ জানান, সামনের ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। বিশ্বের সব পেশার মানুষের অধিকার আছে প্রাপ্য সম্মান ও কর্মক্ষেত্রে সাহায্য লাভের। তাঁদের এই চেষ্টা ছিল শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সামান্য প্রয়াস। তাঁর মতে, তরুণেরাই পারে দেশের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

সব কাজ শেষে বন্ধুরা ও ক্যানটিনের কর্মচারীরা একসঙ্গে খাবার গ্রহণের পর সবাই একসঙ্গে বসে, একই সুরে প্রাণখুলে গান করেন, তখন তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ছিল না কোনো বৈষম্য। সবাই মানুষ এবং মানবিকতাই হলো পরম সত্য—এই কথাটাই যেন প্রতীয়মান।

সেদিন যে বন্ধুরা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তাঁরা হলেন আবু বকর সিদ্দীক, বুলবুল আহমেদ, সাদ্দাম হোসেন উদয়, আনিসুর রহমান, আবু তালেব, সাজ্জাদ হোসেন, হাসান আল-বান্না, জসীম উদ্দিন খান, শাহীন আলম, খাইরুল ইসলাম, আশিকুর রহমান, লিটন হাসান, মো. সাকিল আহমেদ, আল আমিন শেখ, মো. মেহেদী হাসান, মো. নূরুল হক, শফিউল ইসলাম, তানভির, সালাম, জামিত। তাঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধু।

লেখক: সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ